বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানির চেয়ে কম্পিউটার নির্মাণে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করে তুলতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে
অবশেষে আমদানিকৃত কম্পিউটার ও এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মূল্য বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় প্রস্তুতকারকরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানির চেয়ে কম্পিউটার নির্মাণে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করে তুলতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সরকার বিগত কয়েক বছর ধরেই এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী, চলতি বছরেই এটি আলোর মুখ দেখতে পারে।
যদি ২০২১-২২ অর্থবছরের আসন্ন জাতীয় বাজেটে এই প্রস্তাবটি পাস হয়, তাহলে আমদানিকারকদের কম্পিউটার পণ্য এবং অতিরিক্ত যন্ত্রাংশগুলোতে উচ্চ শুল্ক দিতে হবে, যা ইতোপূর্বে শুল্কের তালিকার বাইরে ছিল। অন্যদিকে, কম্পিউটারগুলি যদি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, তবে তার ওপরে আরোপকৃত শুল্ক কম হবে।
সূত্রমতে, স্থানীয় কম্পিউটার শিল্পের উন্নয়নের জন্য আসন্ন বাজেটের আগে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেই প্রস্তাবনায় দেশে কম্পিউটার উৎপাদন সম্পর্কিত ৩টি বিভাগের কথা উল্লেখ করা হয়।
প্রথমত, যারা স্থানীয়ভাবে কম্পিউটার এবং খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করবে তাদেরকে শুল্ক প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, কম্পিউটারের সংস্থাগুলোও ট্যাক্স ছাড় পাবে। তাদের ওপর প্রায় ৪-৫% কর প্রস্তাবিত হয়েছে।
মূলত বিদেশ থেকে কম্পিউটার আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য বড় শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার হার প্রায় ৩০-৩২%।
যদি শেষ পর্যন্ত এই কর আরোপ করা হয়, তাহলে আমদানিকৃত ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং ল্যাপটপের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং সবাইকে উচ্চ মূল্যে কম্পিউটার কিনতে হবে।
আরও সময় চান অংশীদাররা
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) মতে কম্পিউটার ও খুচরা যন্ত্রাংশকে শুল্কমুক্ত করতে হবে। শিল্প সংশ্লিষ্ট লোকরা ১৯৯৬ সাল থেকেই এ দাবি জানিয়ে আসছে। দিন দিন এই চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে কম্পিউটার পণ্যগুলোর ওপর আরোপ করা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সেই থেকে এই খাতটি শুল্ক ও করমুক্ত।
আমদানিকারকরা বলছেন, কম্পিউটার ও কম্পিউটারের খুচরা যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক আরোপের ব্যাপারে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে খারাপ প্রভাব পড়বে।
যদি আসন্ন বাজেটে শুল্কমুক্ত প্রণোদনা না পাওয়া যায় এবং স্থানীয় প্রস্তুতকারকরা খুব শীঘ্রই প্রস্তুতি সম্পন্ন না করেন, তাহলে কম্পিউটারের মূল্য বৃদ্ধি গ্রাহকদের ভোগান্তির কারণ হতে পারে।
তাইওয়ানের কম্পিউটার ব্র্যান্ড আসুসের এক কর্মকর্তা জানান, এটি এই শিল্পে একটি বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশে আসুসের বিপণন ব্যবস্থাপক নাফিস ইমতিয়াজ বলেন, কম্পিউটার ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশে যদি আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয় তবে বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। “স্থানীয়ভাবে এভাবে কম্পিউটার তৈরির প্রক্রিয়াটি এখনও দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার।”
উদাহরণস্বরূপ, তিনি মোবাইল ফোনের ওপর আরোপিত সর্বশেষ আমদানি শুল্কটির কথা উল্লেখ করেন যার ফলে স্মার্টফোনের দাম বেড়েছে, যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান।
তিনি আরও বলেন, "কম্পিউটার এবং খুচরা যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে।"
বর্তমানে দেশের কম্পিউটার বাজার মূলত আমদানির উপর নির্ভরশীল। স্থানীয়ভাবে রাতারাতি কেউ আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারবে না। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে শুল্ক আরোপ করা হলে দিনশেষে কম্পিউটার ক্রয়ে আরও অর্থ করতে হবে।
প্রত্যেককে বাস্তবতা বুঝতে হবে কারণ আমদানি শুল্ক আরোপের আগে স্থানীয় কম্পিউটার উৎপাদন বিকশিত হওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন।
আসুস বাংলাদেশের মার্কেটিং ম্যানেজার ভাষ্য অনুযায়ী, “এর জন্যে এক বা দুই বছরের বেশি সময় লাগবে না। উৎপাদনের জন্য ব্যয়বহুল এবং কাঁচামাল সম্পর্কিত একটি সমস্যাও রয়েছে।"
শীর্ষস্থানীয় কম্পিউটার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রায়ান্স কম্পিউটারের প্রোডাক্ট ম্যানেজার সাইদুর রহমান বলেন, তারাও আমদানি শুল্ক আরোপ করা দেখতে চান না কারণ এটি তাদের ব্যবসার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
তবে কম্পিউটার ও খুচরা যন্ত্রাংশের উপর শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করারও সুযোগ রয়েছে জানায় বিসিসি।
বিসিসির পরিচালক (সিএ অপারেশন এবং সুরক্ষা) এবং পরিচালক (ডেটা সেন্টার) তারেক এম বরকতউল্লাহ বলেন, "আমরা কি কেবল আমদানির উপর নির্ভর করব? স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা আগেও বলেছিলাম। তবে স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে কর আরোপ করা উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "তবে আমরা এখনও এ সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাইনি। আসন্ন বাজেটে এটি যেহেতু এখনও উপস্থাপন করা হয়নি, তাই এখনই আমরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।"
এদিকে, সম্প্রতি ওয়ালটন একটি কম্পিউটার উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছে। ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ সেখানে উত্পাদিত হয় এবং বিশ্বের কমপক্ষে ৫টি দেশে রফতানি হয়।
মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে কি হবে?
যদিও ১৪টি প্রতিষ্ঠানের মোবাইল প্রস্তুতকরণের সনদপত্র রয়েছে, তবে তার মধ্যে ১০-১২টি প্রতিষ্ঠানে মোবাইল তৈরি করা হয়। এছাড়াও আরও দুইটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পাবার অপেক্ষায় রয়েছে।
ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যতিত মোবাইল ফোন, স্মার্ট টিভি, রেফ্রিজারেটর তৈরির জন্যে স্যামসাং একটি কারখানা স্থাপন করে। তবে সেই কারখানায় কম্পিউটার প্রস্তুত করার জন্যে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি কম্পিউটার এবং এর সাথে সম্পর্কিত পণ্যগুলিতে স্বল্প শুল্ক আরোপ করা হলে তা দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
তিনি বলেন, “শুল্ক কেবল আমদানি করা কম্পিউটারের ওপর আরোপ করা হবে। আমরা খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্কমুক্ত রাখার চেষ্টা করছি।"
এর আগে মোস্তফা জব্বার শুল্ক ও কর আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
এখন আমদানি শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে তার মন্তব্য কম্পিউটার উৎপাদনে দেশের সক্ষমতার প্রমাণ দেয়।
তিনি আরও বলেন, “এখন আমরা মোবাইল ফোন রফতানি করছি। যদি আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা থাকে তবে তার ব্যয় ১৫-২০% হ্রাস পাবে এবং বিদেশে আমরা বাংলাদেশি কম্পিউটার রফতানিও করতে পারি। এর ফলে দেশের কর্মসংস্থানও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।"
মতামত দিন