মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিপ
‘বিপ মেসেঞ্জার’, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে যা ছিলো সম্পূর্ণ অপরিচিত এক নাম, কিছুদিন আগে অনেকটা আচমকাই ফেসবুক, ইমো এবং হোয়াটসঅ্যাপের একচেটিয়া বাজারে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে ব্যবহারকারীগণ ক্রমাগত অন্যান্য এপ বিমুখ হয়ে বিপের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বিপের এই নব্যউত্থান কি প্রতিষ্ঠিত এসব মেসেজিং কোম্পানীর দিকে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে?
নাকি হুজুগের মতো খুব দ্রুতই মিলিয়ে যাবে?
ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, সময়ের প্রেক্ষিতে বিপের এই উত্থান বিভিন্ন কারণে লক্ষ্যণীয়। বিপের আকস্মিক উত্থান এবং হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহাকারীর সংখ্যার ক্রমহ্রাসমানতা ব্যবহারকারীদের মনোভাব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করে।
২০১৪ সালে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপকে কিনে নেয়ার পর থেকেই ব্যবহারকারীদের মধ্যে কি পরিমাণ তথ্য আদান প্রদান হতে পারে দুটি কোম্পানীর মধ্যে এ নিয়ে গুঞ্জন চলছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে হোয়াটসঅ্যাপ চালু করলেই ২০১৬ সাল থেকে ফেসবুকের সাথে তথ্য আদান-প্রদান বিষয়ক পদক্ষেপের একটি নোটিফিকেশন আসে যা ব্যবহারকারীদের তিক্ততা আরো বাড়িয়ে তোলে।
জানুয়ারীর ৪ তারিখে হোয়াটসঅ্যাপ মূলত ব্যবসায়িক একাউন্ট ব্যবহারকারীগন কিভাবে তাদের তথ্যাবলী সংরক্ষণ করতে পারেন সেই বিষয়ে তাদের ব্যবহারের শর্তাবলী এবং গোপনীয়তার নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনে।
একটি পপ-আপ মেসেজে ঘোষণা দেয়া হয় যে ৮ জানুয়ারী থেকে হোয়াটসঅ্যাপের নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আসবে এবং ব্যবহারকারীকে সেটি মেনে নিতে হবে।
সেই গোপনীয়তা নীতি পরিবর্তনের অংশ হিসাবে, হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের সাথে নির্দিষ্ট তথ্য আদান-প্রদান না করার বিষযটি মুছে দিয়ে ভিন্ন একটি মেসেজও দিচ্ছে, “আপনি যদি ব্যবহারকারী হোন তাহলে আপনার ফেসবুক একাউন্টে আসা বিজ্ঞাপণ ও সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত সার্ভিস উন্নত করার জন্যে আপনার হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্টের তথ্য শেয়ার না করার অপশন বেছে নিতে পারেন।”
এই বার্তা কিছু ব্যবহারকাররীকে দ্বিধান্বিত করে এবং তারা ধরে নেন, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে হলে ফেসবুকের সাথে তথ্য আদান প্রদান না করার কোন বিকল্প থাকছে না।
প্রকৃতপ্রস্তাবে গোপনীয়তার নীতি মুছে ফেলা ভিন্ন ইঙ্গিত করছে। অর্থাৎ ২০১৬ সাল থেকে হোয়াটসঅ্যাপ তার ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর একটা বড় অংশের তথ্য ফেসবুকের সাথে আদান প্রদান করেছে।
আসা যাক বিপ মেসেঞ্জার প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবহারকারীগণ হোয়াটসঅ্যাপের নীতিমালার চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত সহজভাবে নেন নি। ফলশ্রুতিতে তারা বেছে নিয়েছেন ভিন্ন অ্যাপস।
ফলশ্রুতিতে বিপ, সিগনাল এবং টেলিগ্রাম সহ আরো দুটি অ্যাপস হুট করেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এদের মধ্যে বাংলাদেশে গুগোল প্লে স্টোরে মেসেজ দেয়া-নেয়া অ্যাপসের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বিপ মেসেঞ্জার।
মার্চ ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিপ এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪.৫কোটি যা জানুয়ারী ২০২১ এ এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ কোটির বেশি!
জেনে নিন বিপ সম্পর্কে
হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার বা মেসেঞ্জারের মতোই বিপ অডিও এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করার অ্যাপস তবে তুরস্কভিত্তিক এই কোম্পানীটির কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীর গোপণিয়তা কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা ঘোষণা দিয়েছে।
কোম্পানিটির ২৬.২ শতাংশ শেয়ারের মালিক তুরস্ক সরকার, ১৩.৮১ শতাংশের মালিকানা রয়েছে কারামেহমেতের কোম্পানী সুকুরোভা হোল্ডিঙের,রাশিয়ান বেসরকারি কোম্পানীর অধীনে রয়েছে ১৩.২২ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৪৮.৯৫ শতাংশের মালিকানা তুরস্কের শেয়ার মার্কেটে রয়েছে।
কোম্পানীর দাবি অনুযায়ী অ্যাপটিতে যাওগাযোগ ব্যবস্থা দুই পার্শ্বে এনক্রিপশেনের ব্যবস্থা থাকায় সব তথ্য নিরাপদ থাকবে এবং তথ্য চুরি হবার কোন ঝুঁকি নেই।
অ্যাপ নির্মাতাদের মতে গোপন বা পৃথকভাবে আন্তঃযোগাযোগের অপশন, নির্দিষ্ট সময় পর ব্যবহারকারী চাইলে তার পাঠানো বার্তা মুছে ফেলার সুবিধা থাকার ফলে তথ্য পাচার বা চুরির সুযোগ থাকছে না। তথ্য কখন মুছে যাবে সেই সময় নির্ধারণের সুযোগ থাকছে ব্যবহারকারীর উপর। অর্থাৎ`` নিজের তথ্যের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছেন ব্যবহারকারী।
তুরস্কের মোবাইল কোম্পানি টার্কসেল ২০১৩ সালে বিপ চালু করেছিলো। বিশ্বের ১৯২টি দেশে বর্তমানে এর ব্যবহারকারী রয়েছে যার অধিকাংশই ইউরোপীয় অঞ্চলের অবস্থিত।
বিবিসির দেয়া তথ্য অনুযায়ী জার্মানীতে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা হয়েচেহ বিপ এবং সেখানে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বেশি। এছাড়া ফ্রান্স এবং ইউক্রেনেও প্রচুর ব্যবহারকারী রয়েছেন।
টার্কসেলের দেয়া তথ্যে জানা যায় বর্তমানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে অ্যাপটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকহারে।
তবে বাংলাদেশে অ্যাপটির জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গেছে অন্য সব কিছুকে। একদিনেই ডাউনলোডের ক্রম তালিকার ৯২ ধাপ অতিক্রম করে উঠে এসেছে শীর্ষে।
তুরস্কের সংবাদপত্র সাবাহ এর দেয়া তথ্য মোতাবেক হোয়াটসঅ্যাপ তাদের গোপনীয়তার নীতিমালায় পরিবর্তন আনার ঘোষণার সাথে সাথেই বিপ অ্যাপ এক দিনে প্রায় ২০ লক্ষবার ডাউনলোড হয়েছে বাংলাদেশে।
এযাবৎ প্রায় ৬ কোটি বার ডাউনলোড হয়েছে অ্যাপটি। টার্কসেল কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে শীঘ্রই প্রায় ১০০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলকে পৌঁছে যাবে বিপ।
ধর্মীয় চেতনা নাকি ব্যাক্তিগত সচেতনতা
বিশেষজ্ঞগণের মতে ব্যাক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার পাশাপাশি একাধিক কারণ বিপের জনপ্রিয়তার পেছনে অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
প্রথমত, বিশ্বব্যাপী নেটিজেনরা ব্যাক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার বিষয়ে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। বাংলাদেশেও এর ব্যাতিক্রম নয়। ফলশ্রুতিতে বিপ তাদের পছন্দের শীর্ষে চলে এসেছে।
সম্প্রতি তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইপ এরদোয়ান হোয়াটসঅ্যাপের পরিবর্তে বিপ ব্যবহারের ঘোষনা দিয়েছেন। অনেকের মতে এটি একটি প্রভাবকের কাজ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
আকস্মিক জনপ্রিয় হয়ে উঠা বিপের বিষয়টি নজরে আনার প্রশ্নে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের উপ পরিচালক (মিডিয়া), জনাব মোঃ জাকির হোসেন খান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, সাধারণত নতুন কোন অ্যাপস আসলে আমরা সেটি পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসি। তাৎক্ষনিকভাবে কোন অ্যাপের ব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মন্তব্য করা সম্ভব নয়। এর ভালো-মন্দ দিক নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের বিস্তারিত জানাবেন তাদের তদন্ত শেষ হবার পর।
জনাব জাকির হোসেন খান টেলিগ্রাম নামক অ্যাপের বিষয়েও মন্তব্য করেন এই বলে যে, দুবাই ভিত্তিক এই অ্যাপটিও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে উগ্র ডানপন্থী এবং জংগীবাদীদের কর্মকান্ডে এটি ব্যবহার হচ্ছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “যদি আমরা দেখতে পাই যে জঙ্গি সংগঠনের ব্যবহারের জন্য টেলিগ্রামের মতো বিপের কার্যক্রমও সন্দেহজনক, তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মতামত দিন