এই ছাপান্নোতেও গেয়ে, বাজিয়ে মাতিয়ে যাচ্ছেন জেমস, দুষ্টু ছেলের দল এখনও গুরু মানে তাকে
পলাশ ভাইয়া, লিটন ভাইয়া আমাদের দুই খালাতো ভাই। দুজনই গিটার বাজাতে পারতেন। দশকটা আশির দশকের শেষে। বাংলাব্যান্ডের উত্থানকাল তখন। আমি পড়ি হয়তো ফোর ফাইভে।
তখনও নগরবাউল ফর্ম করেনি। জেমস ছিলেন ফিলিংসের প্রধানতম হয়ে। অনন্যা, রিকশাওয়ালা গানগুলো বড়ভাইদের গলায় প্রথম শোনা। জেমস তখন স্বকীয় হচ্ছেন একটু একটু করে। শহর জুড়ে নানা মিথ তার গায়কী, বাদন নিয়ে। একটা উদাহরণ দেই...
লিটন ভাইয়া একদিন বললেন, জেমস দাঁত দিয়ে গিটার বাজাতে পারে জানিস? আমি হতভম্ব। বললাম, “কীভাবে সম্ভব? বললেন, পারে, পারে। আমার বালক মন অবিশ্বাস সত্ত্বেও মেনে নিলো বড় ভাইয়ের কথা। জেমসের গিটার, জেমসের দাঁত বলে কথা!”
“জেল থেকে বলছি”র ৩৫ টাকা ভাইয়ার জোটানো। মিরপুর ঠিক দশ নম্বরে তখন ক্যাসেটের দোকান “চৌধুরী উদ্যোগ”। মিরপুর স্টেডিয়ামে ছিল রোজ ভ্যালি’র মিরপুর শাখা। এই দুই জায়গা থেকেই আমরা ক্যাসেট কিনতাম। আর ছিল এক নম্বরে বৈশাখী মার্কেটের দোতলা।
“জেল থেকে বলছি”র “ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে” আমার বেশি বেশি ভালো লাগে। তুমি আসবে ফিরে রূপসী নগরে- লাইনটা শুনলে রূপনগরের কথা মনে হতো। রূপনগর তো রূপসী নগরই ছিল একটা। শুধু অপরূপ বিল ঝিল নদীময় এক জনপদ। এসময়ের দখলদারগুলোর বোধহয় জন্মই হয়নি তখনও।
জেমসকে প্রথম লাইভে দেখি শাহীন কলেজের মাঠে। সেখানে বামবা’র কনসার্ট হতো। মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্থবির হয়ে শুনি তার গান। আরও ব্যান্ড ছিল সে আয়োজনে। জেমস স্টেজ থেকে নামার আগে সমাবেত হাজারো তরুণের উদ্দেশ্যে বললেন, “দেখা হবে। পথে, বিপথে, সুবহে সাদিকে।” অ্যালবামের জেমস আর লাইভের জেমসে তফাৎ বহুগুণ। সেটা বুঝলাম। তর নিজের একটা প্লে লিস্ট থাকে কনসার্টে। ভক্তরা যাই শুনতে চান তা গাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব জেমস নন। নিজের ইচ্ছেমতো তিনি চলেন। গানের ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ বেজে ওঠে তাঁর লিড গিটার। সে সুরের নিজস্বতা কারো সঙ্গে মেলে না।
মনিপুর স্কুলে ভর্তির এক বছরের মাথায় বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতে। কাছাকাছি সময়ে বের হয় জেমসের সলো “দুঃখিনী দুঃখ করো না”। আইসিসি টুর্নামেন্টে বারো কোটি দেশবাসীর কান ছিল রেডিওতে। ফাইনালে কেনিয়ার সঙ্গে ম্যাচ। শেষ ওভারের শেষ বল। পাইলটের লেগবাইয়ে এক রান আসে। বদলে যায় বাংলাদেশ। ঘরে আর কেউ ছিল না সেদিন। একটি রঙিন মিছিলের শহর দেখার সৌভাগ্য হয়। স্কুল ছুটি হয়ে যায় আগেই। আমরা বালতিতে রঙ গুলাই। মিছিল শুরু করি। মগে রঙ ঢেলে প্রথমে ছিটাই স্কুলের স্যার ম্যাডামদের। এ অপরাধে টিসি হতে পারতো। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি- স্যার, ম্যাডামরা হাসছেন। হেড স্যার এসে বললেন, “যা করবি স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর করবি।”
স্কুলে আরও জেমস ভক্ত পাই। আমরা স্কুলের সাদা শার্ট রঙিন করে চিৎকার করে গাইতে থাকি- “এসো চুল খুলে পথে নামি, এসো উল্লাস করি।” আমাদের জেতার দিনে জেমসের গান সঙ্গী হয় এভাবে।
শুধু গান না। পোশাকেও জেমসকে ফলো করতাম। আমরা নিয়মিতই পাঞ্জাবির সঙ্গে জিন্স, পায়ে বুট পরা শুরু করি।
এরপর স্ক্রু ড্রাইভার, ক্যাপসুল ফাইভ হানড্রেড মিলিগ্রামে এলআরবি’র সঙ্গে জেমসকে পাই ক্যাসেটের বি- পিঠে। কোন পেশা নিয়ে জেমসের গান নেই? মান্নান মিয়ার তিতাস মলম থেকে লেইসফিতা হয়ে সেলাই দিদিমণি...।
ভাইয়া-ভাবির র্যাগ ডে’তে জাহাঙ্গীরনগরে জেমস আসেন। সেই টানে একদিন আগে থেকেই আমি ভাসানী হলে। মুক্তমঞ্চের সেই সন্ধ্যা ভুলব না আমৃত্যু। চাঁদ যেন নিচে নেমে এসেছিল সে রাতে। প্রায় ৩ ঘন্টা টানা পারফর্ম করেন জেমস। এক গ্লাস জোছনা আর এক গ্লাস অন্ধকার হাতে আমি সাক্ষ্য ছিলাম সে রাতের।
এরপর আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জেমসের শীর্ষযাত্রা। বিশাল একটি তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি এখন গুরু। ভর করেছিলেন ৯০ এর শ্রেষ্ঠ গীতিকবিদের ওপর। শুধু নব্বই কেন? শামসুর রাহমানের উত্তর কবিতায় সুর দিয়ে সৃষ্টি হয় “তারায় তারায় রটিয়ে দেব তুমি আমার।” এককভাবে বাংলা গানের ধারা বদলে যায় জেমসের ধারালো লিরিক আর দরাজ কণ্ঠে।
হিন্দি ছবিতে “ভিগি ভিগি” শুনে একটু মন খারাপ হয়েছিল। জেমস কি জানতেন না মহিনের ঘোড়াগুলোর জনপ্রিয় এ গানটির সুর? পরে মনে হয়েছে এটি আপোস অথবা কৌশল। শিল্পীস্বত্ত্বা চায় ছড়িয়ে পড়তে। সীমানা, ভাষা, দেশ ছাড়িয়ে।
সাংবাদিকতা জীবনে অনেক ফিচারে, হেডিংয়ে উসকানি এসেছে জেমসের গান থেকে। বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের দিন এক স্টোরির হেডিং দিয়েছিলাম- “ ইয়া রব, ইয়া রব জিকিরে মুখরিত টঙ্গির ময়দান।” এক সহকর্মী বললেন, "জিকির তো ইয়া রব বলে হয় না। ইয়া আল্লাহ বলে হয়।"
আমি বললাম, আল্লাহ কি রব নন? তখন চুপসে গিয়েছিলেন তিনি।
এই ছাপান্নোতেও গেয়ে, বাজিয়ে মাতিয়ে যাচ্ছেন জেমস। দুষ্টু ছেলের দল এখনও গুরু মানে তাকে। এসবই হয়েছে তার ব্যক্তিত্ব গুণে। ফেসবুক লাইভ, টিভি টক শো’তে বকবক, মিডিয়া পাড়ায় গিয়ে সাংবাদিক তোষামোদ এই বৃত্তের অনেক দূরে তার অবস্থান। রাত জাগারা এখনও শোনে “আমি আর এক ফালি নিষ্পাপ চাঁদ, সারা রাত কথা বলে হয়েছি উদাস।” এই উদাস দেবতাই জেমস। বিলীন হওয়া বাউলকে যিনি খুঁজে ফেরেন নগরে।
জন্মদিনে অজস্র শুভেচ্ছা ফারুক মাহফুজ আনাম জেমসকে। আশ্চর্যময় আপনার সময়ে বেঁচে থাকা। বন্দির হাতে জেলের চাবি তুলে দেওয়া আপনাকেই মানায়। শুভ হোক মানবজীবন।
হাসান শাওনের জন্ম , বেড়ে ওঠা ঢাকার মিরপুরে। পড়েছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।
২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই ‘‘হুমায়ূনকে নিয়ে’’ প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন