শহরাঞ্চলের গ্যারেজ, কারখানা কিংবা বেকারিতে একটু নজর দিলেই দেখা মিলবে হতদরিদ্র শিশুদের, এক রূঢ় বাস্তবতায় দিনাতিপাতের কঠিন চিত্র
শিক্ষা শিশুদের মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে (বিশেষত চরাঞ্চলে) ও শহরাঞ্চলের বস্তিতে সেই অধিকার আজও অনেকাংশে উপেক্ষিত। শিশুরা বেড়ে উঠছে নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে। নিম্নবিত্ত ও পথশিশুদের দিনাতিপাত হচ্ছে রাস্তায় প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে, কখনো বা স্টেশনে শ্রম বেচে। অল্প মজুরিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো যায় বলে, মালিকেরাও শিশুদের বেশি নিয়োগ দিচ্ছে, কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ৷
শহরাঞ্চলের গ্যারেজ, কারখানা কিংবা বেকারিতে একটু নজর দিলেই দেখা মিলবে হতদরিদ্র শিশুদের, এক রূঢ় বাস্তবতায় দিনাতিপাতের কঠিন চিত্র।
এই সমাজবাস্তবতায় করোনা মহামারি যেন আঘাত হানে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় রূপে। স্কুল-কলেজসহ যাবতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ২০২০ সালের মার্চের ১৭ তারিখে। মাত্রই ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা সৌমিকের মতো হাজারো শিশু-কিশোর ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। মার্চে যখন তার স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো, সেই সাথে যেনো তার সুন্দর দিনগুলো ও গেলো অস্তাচলে। গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান সৌমিকের বাবার রিকশার চাকা তখন আর চলে না। সাত সদস্যের পরিবারের অন্নের ব্যবস্থা করতে উপায়ন্তর না দেখে সৌমিককে অন্যের জমিতে কাজে লাগিয়ে দিলো তার বাবা। এখন পড়াশোনা থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে সৌমিক। এই শিশু বয়সে, পরিবারের অন্নের যোগান দিতে, সে কাঁধে বয়ে চলেছে রাজ্যের বোঝা। তবে এখনো মাঝে মাঝে গরুর পাল নিয়ে মাঠে যেতে যেতে তার মনে পড়ে, সেই সোনালি দিনগুলোর কথা! যখন সৌমিক পঞ্চম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে তখন সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলো। সবাই তার কত তারিফই না করেছিল সেদিন! হেডমাস্টার স্যার নিজে তাদের বাড়িতে এসে সৌমিক কে একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব দিন এখন শুধুই অতীত। করোনাভাইরাসের করাল থাবা তার সোনালি দিনগুলোর উপন্যাসটা আর বাড়তে দিলো না।
এমন সৌমিকের সংখ্যাটা,যেনো করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের ১৩০টি দেশে করোনাভাইরাস মহামারিতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বর্তমানে ১০০ কোটির ও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শিশুদের ওপর করোনাভাইরাসের ভয়াল প্রভাব পরোক্ষভাবেই বেশি পড়েছে। মহামারিতে অনেকের বাবা-মা মৃত্যুবরণ করেছে, আবার অনেকের বাবা-মা হারিয়েছেন চাকরি। ফলে তাদের পরিবারের জীবনধারণ হয়ে দাড়ায় দুঃসাধ্য! তখনই শিশুদের নানা কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য হচ্ছে পরিবার।
এ বিষয়ে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, “সংকটের সময়ে অনেক পরিবারই টিকে থাকার কৌশল হিসেবে শিশুশ্রমকে বেছে নেয়।” যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আজ আমরা বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হতে দেখছি।
করোনাভাইরাস মহামারিতে লাখো শিশু শিক্ষার্থী শিক্ষার আলো থেকে চিরতরে অন্ধকারে চলে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে।শিক্ষা তাদের মৌলিক অধিকার হলেও, পরিবারের হাল ধরার জন্য, নিজেদের হালের নিয়ন্ত্রণ তারা হারিয়ে ফেলেছে। শিক্ষার ছায়া থেকে তারা ক্রমশই শতক্রোশ দূরে চলে যাচ্ছে।
দেশের অদূর ভবিষ্যত, আজকের শিশুরা, যেনো করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষাগ্রহণ থেকে ঝরে না পড়ে, সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা অত্যাবশ্যক-
- স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে অনুপস্থিত শিশুদের আবারও নিয়মিত স্কুলমুখী করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা। কমিটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও শিক্ষকদের দ্বারা গঠিত হবে। তাদের মূল দায়িত্ব হবে স্কুলের অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের আনয়নের ব্যবস্থা করা।
- শিশুদের অল্পতেই মানসিক চাপ অনেক বেড়ে যায়। করোনা মহামারিতে স্কুলে যেতে না পারা, বন্দিজীবনে দীর্ঘসময় আটকে থাকা ও পরিবারের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য বিদ্যালয় খোলার পর, প্রতিটি বিদ্যালয়ে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন করে শিশুদের মানসিক ভারসাম্য পুনরায় স্বাভাবিক করতে হবে।
- এখনও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে করোনা সংক্রমণের হার না কমায়। এক্ষেত্রে যখনই সংক্রমণের হার কমে আসবে , সরকারি নির্দেশ সাপেক্ষে, অতিসত্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। কেননা, যত দেরি হবে, ততই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বাড়তে থাকবে। তবে, সেক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেন আবারও না বাড়ে সেজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখার বিষয়টাও চিন্তা করা অতীব জরুরি। শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন শিফটে ভাগ করে, ক্লাসের সংখ্যা সীমিত করে ও সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি পালনের শর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাবস্থা করা উচিত।
আজকের শিশুরাই আমাদের আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। আমাদের শিশুদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা আমাদেরই দায়িত্ব। তাদের মাধ্যমেই আসবে পরিবর্তন, উন্নত হবে জাতি। তাদের এই অধিকার যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তারা পায় সে ব্যাপারে সবাইকে রাখতে হবে সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি। মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলের কোনো শিশুই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
জাতি,ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয় তার ওপর আলোকপাত করা অতীব প্রয়োজন। করোনাভাইরাস মহামারিসহ কোনো দুর্যোগেই যেন তারা পথ না হারায় তার জন্য দুর্যোগকালীন সময়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা যায়।
যারা (পূর্ণবয়স্ক) ইতোমধ্যে বিভিন্ন কাজে ঢুকে পড়েছেন ,তাদের শিক্ষিত করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। অর্থাৎ, বর্তমানে শিক্ষার হার ১০০ ভাগে নেয়া অনেকটা অসম্ভব প্রায়৷
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপমতে, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০%। কিন্তু, চর ও পথশিশুদের জন্য আলাদা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে তাদের মূলধারায় নিয়ে আসা গেলে এবং বর্তমানে সারাদেশের শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখতে পারলে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ শতভাগ শিক্ষিত এক জাতি পাবে। যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এক্ষেত্রে, আমাদের নিকটবর্তী দেশ চীন একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। তারা তাদের নাগরিকদের ছোট থেকেই কারিগরি শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের হাত ধরেই পুরো বিশ্ব আজ আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে। চীন তাদের নাগরিকদের সুশিক্ষিত করে আজ পুরো পৃথিবীর সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে। যার মূলে রয়েছে তাদের অধিক শিক্ষিত জনশক্তি উৎপাদন।
করোনাভাইরাস মহামারিতে শিশুদের শিক্ষার অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীরাই নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের আওতায় আসতে পারেনি। ফলে অল্প বয়সে তাদের ঝরে পড়ার হার অন্য সবার চেয়ে বেশি হতে যাচ্ছে যদি না স্কুল খোলার সাথে সাথে তাদের স্কুলমুখী করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷
করোনাভাইরাস পরবর্তী শিশু শিক্ষার মহামারি ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তই হতে পারে উত্তরণের একমাত্র উপায়। শিশুদের শিক্ষার সুপরিবেশ নিশ্চিত করাই আমাদের আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশের ভিত্তি।
আসিফ আলম, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন