আমাদের রপ্তানির বাজারগুলো ধরে রাখতে বাংলাদেশকে এখনই মুক্তবাণিজ্য চুক্তিসহ দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
এলডিসি পরবর্তী সময়ে “জিএসপি প্লাস” সুবিধা পেতে বাংলাদেশের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। ইউরোপের বাজারে স্থায়ীভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে তাদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কথাও বাংলাদেশ বিবেচনা করতে পারে।
বাংলাদেশ যদি ইউরোপে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আমরা কেবল ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত পোশাক রপ্তানি করতে পারব। ইউরোপ অবশ্যই আমাদের পোশাক রপ্তানির একটি অন্যতম বৃহৎ বাজার।
কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আমাদের মোট রপ্তানির একটি অংশ মাত্র ইউরোপে হয়ে থাকে। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাজ্য যা এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি অংশ ছিল, ব্রেক্সিটের মাধ্যমে এখন তারা সংগঠনটি থেকে বেরিয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির একটি বড় বাজার।
কাজেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অন্যান্য বাজার যেমন- কানাডা, নিউজিল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে জিএসপি প্লাস সুবিধা কার্যকর নয়।
এই রপ্তানির বাজারগুলোতে বিশেষ করে ভারত ও চীনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার দ্রুত বড় হচ্ছে। ফলে সেখানে পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি আমাদেরকে মেগা আঞ্চলিক বাণিজ্যচুক্তি করার উদ্যোগও নিতে হবে। সীমিত অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি যথেষ্ঠ নয়। এ বিষয়ে আমরা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেই, তবে পোশাক রপ্তানিতে বিশ্ব বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিযোগী দেশেগুলোর চেয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব।
এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো কী করছে?
আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো অর্থাৎ ব্রুনেই, ক্যাম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং তাদের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির অংশীদার রাষ্ট্রসমূহ অর্থাৎ চায়না, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড মিলে রিজিওনাল কমপ্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) বা সমন্বিত আ লিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব গঠনের ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
আরসিইপিভুক্ত ১৫টি দেশের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০% (২.২ বিলিয়ন) এবং তাদের সমন্বিত জিডিপির আকার বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০% যার পরিমাণ প্রায় ২৬.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কাজেই রিজিওনাল কমপ্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ গঠিত হলে তা হবে পৃথিবীর ইতিবাসে সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অঞ্চল। আরসিইপি অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত আরও সম্প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা যায়।
কাজেই আরসিইপিতে যুক্ত না হলে বাংলাদেশ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হবে। তাই আরসিইপিতে যুক্ত হওয়ার জন্য আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
একইভাবে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১১টি দেশ নিয়ে গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) শীর্ষক অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গেও বাংলাদেশ যুক্ত নয়। ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি থেকে সরে আসে। ট্রাম্প-পরবর্তী যুগে চুক্তি স্বাক্ষরকারী অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম জোটকে পুনর্জীবিত করায় প্রয়াস নিয়েছে এবং তা হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলো টিপিপি জোটভুক্ত যেমন জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা। অন্যদিকে রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়া টিপিপির সদস্য। যার মধ্যে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী দেশ।
ফলে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশ যদি বৃহৎ আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে ব্যর্থ হয় এবং যে দেশগুলো আমাদের প্রধান রপ্তানি বাজার তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি অর্থাৎ এফটিএ এখনই সম্পাদন করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগী সক্ষমতার দিক থেকে একটি বিশাল অসুবিধার মুখে পড়বে।
কারণ আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলোর যুক্ত হওয়ার এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির ফলে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর রপ্তানি শুল্কের পরিমাণ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমে আসবে। অত্যন্ত মূল্য ও খরচ সংবেদনশীল পোশাক শিল্পে এর প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।
বিশ্বে কোভিড অতিমারির প্রভাবও এখানে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড অতিমারিতে আমাদের বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই কোভিড সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হলে আমাদের অবশ্যই বাণিজ্যনীতিসমূহ পুনর্বিন্যাস এবং প্রয়োজনে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে। বিশেষকরে প্রতিযোগী সক্ষমতা বজায় রাখতে কৌশলগত দিক বিবেচনা করে বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাস বা প্রণয়ন করতে হবে।
আমাদের এখানে মনে রাখতে হবে যে, কোভিডের ফলে বর্তমান পৃথিবীর বাণিজ্য পরিস্থিতি এবং ১২ মাস আগের বাণিজ্যচিত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতিরি দেশসমূহ তাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বজায় রাখতে অনেক আগে থেকেই মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে তাদের অর্থনীতির দ্বার উন্মুক্ত করেছে এবং অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ভিয়েতনাম প্রায় এক যুগ আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছিল। অন্যদিকে ভারত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ করার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এফটিএ বা মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি নিছক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শুল্ক পুনঃনির্ধারণের উপায় হিসাবে দেখা হয় না। বরং এফটিএ সম্পাদনকারী দেশগুলো এ ধরনের চুক্তিকে আরও বৃহৎ অর্থনৈতিক পরিসরে এবং পরিসংখ্যানের দিক থেকে বিবেচনা করে থাকে।
এফটিএ সম্পন্ন করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো এর মাধ্যমে একটি দেশ তার সার্বিক অর্থনৈতিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে। শুধুমাত্র শুল্ক সুবিধার কথা বিবেচনা করা এফটিএর একমাত্র উপলক্ষ্য নয়।
অর্থাৎ এফটিএ করার সময় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত দিকগুলো সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
সুতরাং বাংলাদেশের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে এফটিএ করার জন্য এমন ৮ থেকে ১০টি দেশের তালিকা সরকারকে এখনই তৈরী করতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই আরসিইপি এর মতো আ লিক বাণিজ্য জোটে অন্তর্ভূক্ত হওয়া অথবা দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে সুবিধা আদায়ের ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
এজন্য ব্যাপকভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে যা সম্পন্ন করতে হয়ত কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। কারিগতি জটিলতা ও ব্যাপকতার জন্য একটি সুষম এফটিএ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, বিশেষত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের বিষয়ে কাজ করা বেশ কঠিন । চুক্তি সম্পাদনকারী দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমান সুবিধা নিশ্চিত করে এফটিএ করা সোজা কাজ নয়। এফটিএ সম্পন্ন করেছে এমন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায় এফটিএ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সামগ্রিক অর্থনীতি এবং উৎপাদনশীল ও সেবা খাত অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন ও প্রতিবেদন থাকাটা অত্যন্ত প্রয়োজন।
আমাদেরকে স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী একটি সমন্বিত জাতীয় রপ্তানি কৌশল প্রণয়ন করা আবশ্যক। শুধুমাত্র তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে হবে না।
আমরা অতীতে এমন উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম। আমরা পোশাক রপ্তানি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম তা থেকে আমরা বর্তমানে বহুদূরে। আর বিশেষকরে অতিমারির কারণে সেই আশা আরো দুরূহ।
যাই হোক, উচ্চাশা করা দোষের কিছু নয়। উচ্চাশা ও উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা থাকা ভালো যদি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ সেই লক্ষ্য অর্জনের একটি সামগ্রিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারেন। যেখানে সম্ভাব্য চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করার কৌশল প্রণয়ন করা থাকে।
এখানে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা এই কাজ আরও আগে শুরু করতে পারতাম!
সরকারকে দেশের ব্যবসায়ীদের চেম্বার যেমন বিজিএমইএ, বিকিএমইএ এর মতো বাণিজ্যিক সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে এ বিষয়ে কার্যকর আলোচনা শুরু করতে হবে। তবে কেবল প্রচলিত “সভা” করলে এক্ষেত্রে চলবে না। এ বিষয়ে সবচেয়ে পারদর্শী এবং অভিজ্ঞদের আলোচনার টেবিলে আনতে হবে এবং কীভাবে আমরা এক্ষেত্রে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি তার সব ধরনের সম্ভাব্য উপায় বের করার কাজটি এখনই শুরু করতে হবে।
মোস্তাফিজ উদ্দিন
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক,
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন