বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে
১৫ আগস্ট। এ দেশ ও জাতির জীবনে একটি ট্র্যাজিক স্মৃতি। রক্তের আখরে লেখা বেদনা-বিধুর একটি দিন। ১৯৭৫ সালের যে দিনটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। দেশের বাইরে অবস্থানের সুবাদে সৌভাগ্যক্রমে তার বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোট মেয়ে শেখ রেহানা বেঁচে যান। দুঃখ ও শোকের এ গাঁথা এ দেশ ও জাতি ভুলে থাকতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক, তার পরও বছর ঘুরে বার বার দিনটি এ জাতির জীবনে আসবে তাদের বেদনাবোধকে নতুন করে জাগরিত করতে।
এ পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অনেক নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সন্ধান মিলবে, তবে নিষ্ঠুরতার এমন নজির হয়ত খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রশ্ন আসতে পারে, এই অভিঘাত জাতির ক্রমধারায় কি স্থায়ী কোন প্রভাব ফেলতে পেরেছে? এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় হয়তো এখনও আসেনি।
চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতন ইতিহাসেরই অংশবিশেষ। ইতিহাস প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কীর্তির আলোকে চুল-চেরা বিশ্লেষণ করে তার যথার্থ স্থান ঠিকই নির্ধারণ করে দেয়। সে আগে হোক, কী পরে। প্রচার-প্রপাগান্ডা, জুলুম-নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড এসব ইতিহাসের গতিধারাকে হয়তো ক্ষণিকের জন্য ব্যাহত করে, কিন্তু ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যে সব ক্ষণজন্মা মহতী ব্যক্তিরা একটি জাতির ক্রমবিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন তারা পুনঃ পুনঃ স্বমহিমায় দেদীপ্যমান হয়ে উঠেন।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি” নির্বাচনে এক শ্রোতা জরিপের আয়োজন করে এবং শীর্ষ ২০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। জরিপটি করা হয়েছিল এর আগে ২০০২ সালে বিবিসির করা সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০ জন ব্রিটন অনুসন্ধানের জরিপের আদলে। বাংলাদেশ, ভারতসহ (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্য) বিশ্বব্যাপী অবস্থানরত বাঙালিরা জরিপটিতে অংশ নেন। জরিপের ফলাফলে বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে শীর্ষস্থান লাভ করেন। মজার ব্যাপার হলো, তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া রবি ঠাকুরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পয়েন্ট লাভ করেন বঙ্গবন্ধু।
এদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো অনেক বড় মাপের নেতাকে দেখেছেন, যাদের প্রত্যেকেই ছিলেন এক একটি মহীরূহ। কী এমন যাদুর কাঠি শেখ মুজিবুর রহমান পেয়েছিলেন, যার পরশে তিনি এদের ছাপিয়ে জনপ্রিয়তার এমন এক শিখরে আরোহণ করেন, যা এ ভূভাগ অতীতে কখনও দেখেনি, ভবিষ্যতেও হয়তো দেখবে না। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, এটা ছিল তার ঐতিহাসিক ছয়-দফা আন্দোলন, যাতে এ ভূভাগের মানুষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছিল। তিনি তার আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের মানুষের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার বোধকে ভাষা দিয়েছিলেন, তাদেরকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। এখানেই শেখ মুজিবুর রহমানের সত্যিকারের বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির একক, অনন্য, অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠার রহস্য নিহিত। ৭১-এর ৭ মার্চে তার অগ্নিঝরা ভাষণ মুক্তিকামী মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাদের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্তটি সমুপস্থিত।
এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে এদেশের মানুষের ওপর ক্র্যাকডাউন শুরু করলে তাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। রণাঙ্গনের দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে তিনি শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তার নেতৃত্বই এদেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে মুক্ত বঙ্গবন্ধু যখন তার হিমালয়সম জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশে ফেরেন, তার ওপর এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এটিকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়। এই গুরুদায়িত্ব পালনে তার দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তিনি সময় পেয়েছিলেন সাকুল্যে সাড়ে তিন বছর।
ইতিহাসের বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই, তবে এটুকু বললে অত্যুক্তি হবে না, মোটা দাগে তিনি সঠিক পথেই এগোচ্ছিলেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তিনি দেশকে একটি সংবিধান উপহার দেন। যুদ্ধের সময় যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের প্রায় সবাই অস্ত্র ফিরিয়ে দেন।
একজন জাতীয় নেতা হিসেবে সব ধরনের বিরোধ ভুলে তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দেশ থেকে সব ভারতীয় সেনাকে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হন। পররাষ্ট্র নীতিতে তিনি “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়”- এই মূলনীতি গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশকে প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন।
পাকিস্তানের প্ররোচনায় দেশের জন্মলগ্ন থেকে মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশের সাথে যে টানাপোড়েন ছিল, তা তিনি বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং ওআইসির সদস্য পদ অর্জন করেন।
বঙ্গবন্ধু জানতেন, এ জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে শিক্ষাই হবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাই শিক্ষার ভিত্তিমূলকে মজবুত করার প্রয়াসে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি, মুক্ত পরিবেশে নির্বিঘ্নে জ্ঞান চর্চার সুযোগ করে দিতে তিনি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্বশাসন প্রদান করেন। চিকিৎসাশিক্ষার ক্ষেত্রে তার একটি যুগান্তকারী অবদান ছিল, তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের অনুরোধে দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যে ইন্সটিটিউট অব পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর) প্রতিষ্ঠা, যা পরবর্তীতে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি- বিএসএমএমইউ)।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ইসলামি কার্যক্রমে যথাযথ নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্যে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, কৃষি ও কৃষকরাই এদেশের অর্থনীতির মূল শক্তি। এ কারণে কৃষিক্ষেত্রে প্রণোদনা দানে তিনি বেশ কিছু উদ্যোগ নেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষকদের বিএডিসির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচযন্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করা। কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয়ের জন্য তিনি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন।
জ্বালানিখাতেও বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহারের লক্ষ্যে তিনি নিজস্ব ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ মিনারেল, এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমইডিসি) এবং খনিজ তেল ও গ্যাস খাতকে নিয়ে বাংলাদেশ অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কর্পোরেশন (বিওজিসি) গঠন করেন। এর ফলে তার সময়কালেই আটটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।
বলা চলে, মোটাদাগে বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন এই দেশের গতিধারা ঠিক করে দিতে প্রয়োজনমাফিক সবক্ষেত্রেই হাত দিয়েছিলেন। এদেশের মানুষ বিশ্বের দরবারে গর্বিত বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এটাই ছিল তার নিরন্তর কামনা।
তবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে রাতারাতি পাল্টে দেয়ার মতো কোনো আলাদীনের চেরাগ তার হাতে ছিল না। কিছু লোকের দুর্নীতি ও ক্ষেত্রবিশেষে সমন্বয়ের অভাবও তার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুবাদে দেখা দিতে শুরু করে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু সশস্ত্র গ্রুপ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। এমতাবস্থায়, বঙ্গবন্ধু সব দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্লাটফর্ম হিসেবে বাকশাল গঠন করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। সন্দেহ নেই, তার উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, কিন্তু সমালোচকেরা এখানে “গণতন্ত্রের ইতি” দেখতে শুরু করে এবং এটাকেই তাকে ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে লুফে নেয়। এ উদ্যোগ কতটুকু ফলবতী হয় তা দেখার মতো যথেষ্ট সময় মেলেনি। এ কারণে এটা নিয়ে হয়তবা প্রশ্ন থেকেই যাবে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। রেখে গেছেন অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত ও গুণগ্রাহী। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরেছেন প্রায় এক যুগের অধিক হয়ে গেছে।
প্রতি বছর ১৫ আগস্ট নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গুণগ্রাহীরা শোক ও দুঃখ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গকে স্মরণ করেন। এ শোক কেবল তখনই অর্থবহ হতে পারে, যখন তিনি যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমাদের দেখিয়েছিলেন তা অর্জিত হবে। গত ৫০ বছরে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে?
সবাই ভালো থাকুন।
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন, অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না
মতামত দিন