একটি সমাজ যখন নৈতিকভাবে অধঃপতিত হয়ে পড়ে, সমাজের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি বড় অংশের রুচি বিকৃতি ঘটে
হুলুস্থুল চলছে দেশময়। চারিদিকে “গেল গেল” রব। মৌ, পিয়াসা, পরীমণি। একের পর এক মডেল-নায়িকাদের বাসায় বাসায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা হানা দিচ্ছেন, ধরে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের। মদ, মাদক, ডিজে পার্টি আর প্রতারণার নানাবিধ অভিযোগে তাদের বিচারের মুখোমুখি করছেন, রিমান্ডে নিচ্ছেন। উৎসুক জনতার নিরন্তর জিজ্ঞাসা: “কী ব্যাপার? কী থেকে কী হল?” কারও কারও সরেস মন্তব্য: “শেষমেষ তাহলে কত্তা ব্যক্তিদের বোধোদয় হলো!”
আপনি যখন একটি সমাজকে সভ্যতার মানদণ্ডে বিচার করতে বসবেন, যেসব প্যারামিটার আপনার বিবেচনায় আসবে তার প্রধান একটি হবে, ওই সমাজে নারীর মর্যাদা ও অবস্থান। নারী কখনও স্নেহময়ী জননী, প্রেমময়ী স্ত্রী, মমতাময়ী ভগিনী কিংবা আদুরে কন্যা। যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন, নারী মানেই কোমলতা, ভালবাসা আর মমতার আধার। আপনি খুব কম লোক পাবেন, যারা এসব প্রশ্নে আপনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন। কিন্তু, এরপরও আপনি দেখতে পাবেন, যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক মানব সমাজের এক বিপুল অংশে নারী তার প্রাপ্য অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা নিয়ে বাদানুবাদ ও মত-মতান্তর চলে আসছেই। কোন সমাজ যখন নারীর ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের জন্য তাকে চারদেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখার মধ্যে মঙ্গল খুঁজেছে, অন্যরা আবার সব বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে সবখানে সবকাজে পুরুষের পাশাপাশি একই লেভেলে স্থাপনের মধ্যে সমাধান খুঁজে ফিরছে। একদল যখন ভাবছে, নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক; অন্যদল তখন তাদেরকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতেই অনেক বেশি আগ্রহী। এরূপ বহুধা বিভক্ত মতামতের ফলে মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পাদে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে সময়ে সময়ে সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা প্রশ্নে নানাবিধ প্রান্তিক চিন্তাধারার আবির্ভাব ঘটেছে, যা সমাজের সার্বিক স্থিতিকে বিপর্যস্ত করেছে।
যে বিষয়টি সবসময় একটি স্পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছে, তা হলো নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন কেমন হবে, তারা কতটা অবাধে পরস্পরে সঙ্গে মিশবে। নর-নারীর চিরায়ত আকর্ষণ মানবসভ্যতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। শৈশব পেরিয়ে যখন একটি ছেলে বা মেয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয় এবং ক্রমশ পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, তার পুরুষ বা নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে এবং সে বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্য ও সাহচর্য পেতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে।
এই আগ্রহ বাস্তবে কী রকম রূপ পরিগ্রহ করবে তা নির্ধারণে নিয়ামক হয়ে ওঠে সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাচ্যের রক্ষণশীল সমাজে সামগ্রিকভাবে এখনও ধর্মের প্রভাব সুগভীর, যা নারী-পুরুষের পারস্পরিক এই আকর্ষণকে বিয়ের মাধ্যমে পরিণতি দিতে চায় এবং এ বিবেচনায় স্বভাবতই তরুণ-তরুণীর বিবাহ-পূর্ব মেলামেশাকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখতে সচেষ্ট থাকে। অন্যদিকে আধুনিক পাশ্চাত্যে যে কোন বয়সের নরনারীর বাধাবন্ধনহীন মেলামেশা একটি স্বীকৃত বিষয় এবং পারস্পরিক সম্মতিতে নর-নারী তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে যেকোনো পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে, এখানে সমাজ বা রাষ্ট্র কোনোরূপ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকার সুবাদে পাশ্চাত্যের এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রাচ্যে, বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজে, অনেক আগে থেকেই পড়তে শুরু করেছে। সঙ্গীত, নভেল-নাটক ও সিনেমা-থিয়েটারের প্রধান উপজীব্য প্রেম-ভালোবাসা, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে বিবাহ-বহির্ভূত পর্যায়ের। অনেক ক্ষেত্রেই, আপনি দেখতে পাবেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নারীকে যৌনাবেদনময়ী রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেই সাথে অশ্লীল ছবির সহজলভ্যতা পুরো বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের সুবাদে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির এই প্রভাব আরও দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে।
মোটা দাগে, এর একটা বড় প্রভাব পড়ছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের ওপর। এরা অনেকক্ষেত্রেই পরস্পরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ছে, যা অনুমোদনে বৃহত্তর সমাজ প্রস্তুত নয়। মদ, মাদক ও জন্ম-নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজলভ্যতা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সামগ্রিক নৈতিক অধঃপতনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, একদিকে কিছু তরুণীর অভিনয় ও মডেলিংয়ের মাধ্যমে “তারকাখ্যাতি” লাভের মোহ, অন্যদিকে কিছু দূরাচার-দুর্বৃত্ত তারকা ও তারকা-খ্যাতি অর্জনে আগ্রহী সুন্দরী তরুণীদের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে মোটা অংকের অর্থ উপার্জন ও বিশেষ বিশেষ মতলব হাসিলের ফুল-টাইম ব্যবসায় নেমে পড়েছে। কিছু বিপথগামী তরুণী অর্থ-বিত্তের মোহে নিজেরাই এসব দুর্বৃত্তের সহায়তায় এটাকে তাদের একটি পেশায় পরিণত করেছে। দেশের অভিজাত পাড়া ও পাঁচ-তারকা হোটেলগুলোতে মাঝে-মাঝে মদ-মাদকসহ হাই-সোসাইটি “কল-গার্লদের” জমজমাট রাতের পার্টি সামগ্রিক কার্যক্রমের একটি অংশ মাত্র।
এখানে কেবল ধনীর দুলালেরাই টাকা ঢালে না, একশ্রেণির নীতি-ভ্রষ্ট রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ আমলারাও ভিড় জমায়। এ সুযোগে কুচক্রীরা তুলে রাখে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের ছবি, যা পরবর্তীতে ব্যবহৃত হয় ব্ল্যাকমেইলিং করে টাকা আদায় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক বা দাপ্তরিক কাজ হাসিলে। ধারণা করা হয়, নামি-দামী সুন্দরী তরুণীদের অনৈতিক ব্যবহার বিশ্বময় অন্ত- ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় “গোয়েন্দাবৃত্তির” অন্যতম হাতিয়ার।
এভাবেই রাতের রানিরা তৈরি হয় কিংবা তাদের তৈরি করা হয়। এ এক জঘন্য ব্যবসা, যেখানে আমাদের মাতৃজাতি একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিছু দুর্বৃত্তের মনস্কামনা পূরণে কিংবা তাদের বিশেষ মতলব হাসিলে। কোনো তরুণী একবার এ জগতে পা বাড়ালে এমনভাবে এই চক্রের জালে আটকে পড়ে, যেখানে থেকে আর বেরোনোর পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিনিময়ে কী পায় তারা? কিছু অর্থ-বিত্ত ও মেকি যশ-খ্যাতি। এদের কেউ কেউ হয়তোবা মানসিকভাবে এমনভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, এটাই তার কাছে বিশাল প্রাপ্তি বলে মনে হয়, এই দুর্বিষহ জীবনই তার কাছে হয়ে ওঠে উপভোগ্য। বিপত্তি ঘটে যখন ফাঁক-ফোকর গলে এসব কাহিনী সমাজে চাউড় হয়ে পড়ে কিংবা কালে-ভদ্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেরসিকভাবে তাদের ওপর হামলে পড়ে।
একটি সমাজ যখন নৈতিকভাবে অধঃপতিত হয়ে পড়ে, সমাজের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি বড় অংশের রুচি বিকৃতি ঘটে। লোকজন সমাজের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে নারী-ঘটিত কেলেংকারির চর্চা করে একধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। মিডিয়া এসব কেলেংকারির ওপর বিশেষ ফোকাস করে। কারও একটি কেলেংকারি ফাঁস হলে পরিস্থিতি বুঝে অনেকেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যে এটাই একমাত্র কেলেংকারি নয়, তার যে আরও অনেক কেলেংকারি আছে তার ফিরিস্তি দিতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এভাবে, পুরো সমাজ কিছু সময়ের জন্য তাকে নিয়ে অহর্নিশ ব্যস্ত থাকে। শেষমেষ সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থেকে যায়। আমরা একটু স্থিরভাবে ভাবতে চাই না, এ ঘটনাগুলো কেন ঘটছে? সমাধানই বা কী? এই মেয়েগুলো কেন এই অন্ধকার জগতে পা বাড়াচ্ছে? এর পুরো দায়িত্ব কি তাদের একার, নাকি এই নষ্ট সমাজই এসব রাতের রানিদের তৈরি করছে?
সবাই ভালো থাকুন।
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন, অধ্যাপক ও সভাপতি ফার্মেসি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন