হোমমেকিংয়ের পুরো ব্যাপারটাই পারিশ্রমিক আর মূল্যায়নবিহীন এটা জানার পরেও যে এই জীবন বেছে নিচ্ছেন, নিজের আয়ের কোনো উৎস কি রাখছেন আদৌ
নিউজ ফিডে “ট্র্যাডিশনাল ওয়াইফ বনাম ফেমিনিস্ট” শিরোনামে তর্ক-বিতর্ক চলছে বেশ কিছুদিন। কৌতূহল হওয়ায় ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলাম কিছুক্ষণ। হালের “ট্র্যাডওয়াইফ” মুভমেন্টের পরিচিত মুখ ও “দ্যা ডার্লিং একাডেমি” ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা ৩৪ বছর বয়সী যুক্তরাজ্যের অ্যালিনা কেট পেটিটকে ঠিক যেন ‘৭০ দশকের “ঈগল ফোরাম” নামের কনজারভেটিভ পলিটিকাল ইন্টারেস্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকান অ্যাটর্নি মিসেস ফিলিস স্ক্যাল্ফলির একবিংশ শতাব্দীর অবতার মনে হলো। আপনারা যারা ২০২০ সালের “মিসেস আমেরিকা” টেলিভিশন মিনি সিরিজটি দেখেছেন তারা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন এই দুজনের চিন্তাধারা এবং বক্তব্যের সংযোগটা ঠিক কোথায় এবং কেন।
ট্র্যাডওয়াইফ মুভমেন্ট মোটা দাগে যে ধারণাগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত তা অনেকটা এরকম- ঘরই একজন মেয়ের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। স্ত্রীর উচিত স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করা; স্বামী-সন্তান আর সংসারের মঙ্গলে আত্মনিবেদন করা। ঘরের কাজ,রান্নাবান্না, বাচ্চা পালন ও স্বামীর সেবা করাটাই মেয়েদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অন্যদিকে, একজন নারী তার জীবনে যেটাই করতে বা হতে চান না কেন সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করাটা নারীবাদ বা ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের মৌলিক লক্ষ্যগুলোর একটি। ঠিক এই অংশটিতেই অ্যালিনাসহ ট্র্যাডওয়াইফ মুভমেন্টের বাকি মতাদর্শীদের প্রায়শই একটি যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। ফেমিনিজম যদি নারীর স্বেচ্ছায় যেকোনো লাইফ চয়েস বেছে নেওয়াকেই উৎসাহিত করে তাহলে ঘরকন্না হতে চাওয়াটাকে এত খারাপভাবে দেখা হয় কেন? তারাও তো নিজের ভালোলাগা থেকেই স্বেচ্ছায় এই পথ বেছে নিয়েছেন, কারোর কথায় না।
এখন আলোচনা হতে পারে ট্র্যাডওয়াইফদের এই “স্বেচ্ছায়” পুরাদস্তুর গৃহিণী হতে চাওয়াটা আসলেই ঠিক কতখানি স্বেচ্ছায়। সমাজে সেই বহুল প্রচলিত “সংসার সামলানোই মেয়েদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব-কর্তব্য হওয়া উচিত” আপ্তবাক্যটি কি একটু হলেও তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেনি? আশেপাশের মানুষদের সারাক্ষণ “সংসারটা ঠিকমতো সামলাতে না পারলে, বাচ্চাকাচ্চা ঠিকমতো মানুষ না করতে পারলে, স্বামীকে খুশি না রাখতে পারলে মেয়েমানুষের আবার সফলতা কী?” এ ধরনের চিরায়ত লৈঙ্গিক বৈষম্যবাদী মন্তব্যের কবলে পড়ে ভেতরে ভেতরে নিজেকে অপরাধী ভেবে যদি কোনো নারী গৃহিণী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে কিন্তু তাকে আর স্বাধীন “স্বতঃস্ফূর্ত” সিদ্ধান্ত বলা চলে না।
ব্রিটেনের মতো উন্নত একটা দেশের প্রেক্ষাপটে অ্যালিনার একজন ট্র্যাডওয়াইফ হতে চাওয়া আর বাংলাদেশের মতো একটা ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার দেশে কোনো নারীর ট্রেডওয়াইফ হতে চাওয়ার মধ্যকার ফারাকটা যে বিস্তর সেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা হয়ত কষ্টকর। অ্যালিনার দেশের সোশ্যাল সিকিউরিটি তুলনাবিহীনভাবে ভালো; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও যথেষ্ট কার্যকর। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিগত নানা ডিভাইসও তিনি অবাধেই ব্যবহার করতে পারছেন। স্বামী যদি নিপীড়কও হয়, তৈরি আছে পুলিশ বাহিনী। এছাড়া কোনোভাবে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও আমাদের দেশের নারীদের মতো একেবারে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে হয় না, আছে প্রতিষ্ঠিত সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা। সঙ্গে থাকে চাকরির বাজারে দক্ষতা অনুযায়ী নানা কর্মসংস্থানের সুযোগ। এবার নারীরা এই প্রতিটি চিত্রের সঙ্গে আমাদের দেশের পরিস্থিতি তুলনা করে দেখুন তো আপনার দুর্দিনে রাষ্ট্রের আপনাকে সব ধরনের ব্যাকআপ দেওয়ার মতো ব্যবস্থা বা অভ্যস্ততা আছে কি-না?
বাংলাদেশে হোমমেকিংয়ের পুরো ব্যাপারটাই পারিশ্রমিক আর মূল্যায়নবিহীন এটা জানার পরেও যে এই জীবন বেছে নিচ্ছেন, নিজের আয়ের কোনো উৎস কি রাখছেন আদৌ? এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আপনার স্বামী যেকোনো সময়ই একজন নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই পারেন। তাছাড়া তিনি যেকোনো সময়ই একাধিক বিয়ে করতে চাইতে পারেন, আপনাকে তালাক দিতে পারেন। এমনকি দুর্ভাগ্যবশত, হঠাৎ মারা যেতে পারেন বা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে কাজ হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যেতে পারেন। বাচ্চাদের নিয়ে ওইরকম খারাপ পরিস্থিতিতে কী করবেন আপনার হাতে যদি টাকা না থাকে?
তাই আপনি ঘরকন্না হতে চাইলেও অন্তত চাকরির যোগ্যতাটা অর্জন করে রাখুন বা উদ্যোক্তা হওয়ার মতো সম্ভাবনা থাকলে সেটাকে কাজে লাগান। সাথে এটাও মাথায় রাখুন দেশের জব মার্কেটে একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে গেলে জব পাওয়াটাও বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
একটা রুঢ় বাস্তবতা বলি। বিয়ের আগে প্রায় প্রতিটা ছেলেকে দেখা যায় মেয়েদের ঘরকন্নার কাজ, মাতৃত্ব ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করে কথা বলতে। কিন্তু বিয়ের পর অধিকাংশকেই দেখা যায় স্ত্রীকে হাউজওয়াইফ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে, স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যাপারে চরম ঔদাসীন্য দেখাতে। মেয়েদের বিয়ের পর চাকরি করার ব্যাপারে দেখবেন এখনও অধিকাংশ ছেলে এবং তার পরিবার নারাজ থাকে। এর প্রধানতম কারণ হল মেয়েটা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে যায়। তাকে নিপীড়ন করলে মেয়েটির হাতে বাঁচার জন্যে বিভিন্ন রাস্তা খোলা থাকে। আমার আত্মীয়দের মধ্যেই বেশ কয়েকজনকে দেখেছি এমন পরিস্থিতির শিকার হতে। বিয়ের পর তাদের কাউকেই চাকরি করতে দেওয়া হয়নি অথবা চাকরি করলেও সংসার-বাচ্চার দোহাই দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। এরপর সময় বাড়ার সঙ্গে শুরু হয়েছে অত্যাচার আর নির্যাতন। নিতান্তই নিজের হাতে টাকা নেই বলে তারা এখনো মার সহ্য করে পরে আছেন এমন নিপীড়ক স্বামীর ঘরে। কোথায় গেলো তাদের এত বছরের সংসারে করা ত্যাগ আর শ্রমের মূল্যায়ন?
সংসার সামলানো, রান্নাবান্না, বাচ্চা পালন মোটেও তুচ্ছ বিষয় না, বরং অফিস সামলানোর মতোই পরিশ্রমের কাজ। বরং অফিসের মতো ঘরের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমাও থাকে না। দুটোই সম্মান এবং গৌরবের। কিন্তু আমাদের সমাজে গৃহিণীদের তাচ্ছিল্য করা হয়। আরও সমস্যা তৈরি হয় যখন সমাজ ঘরকন্নার কাজকে শুধুমাত্র মেয়েদের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চায়। ফলে চাকরিজীবী নারীদের জন্যে সংসার আর বাচ্চা সামলানোটা হয়ে যায় বাড়তি একটা বোঝার মত কেননা বাড়ির পুরুষটি তাকে কোনো সাহায্য করে না। কারণ সারাজীবন সে শিখেছে এসব শুধুই “মেয়েদের কাজ”!
যৌক্তিক বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেডওয়াইফ হওয়াটা যথেষ্ট আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আর তাছাড়া, কারোর বশ্যতা বা প্রভুত্ব স্বীকার করে একটি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ দাম্পত্য হতে পারে কি-না সে প্রশ্নটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মানুষই স্বাধীন হিসেবে জন্ম নেয়। যে সংসার করতে নিজেকে আরেকজনের অধস্তন ভাবতে হয় সেটা যে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক হতে পারে না তা তো সহজেই অনুমেয়!
নারীরা নিজেদের সত্যিকার ভালোটা বুঝতে শিখবেন কবে?
নুসরাত জাহান, স্বেচ্ছাসেবক ও সমাজকর্মী
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন