‘এখানে সব ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে মানুষ ফোন করেন। তবে জরুরি কলগুলো বেশি আসে। যেমন গর্ভবতী অনেক মা বুঝতে পারেন না তারা কীভাবে খাবার খাবেন বা ডাক্তারের কাছে কোন কোন সময় যাবেন, কখনও হঠাৎ শিশু কিছু খেয়ে ফেললে, নাকে কিছু ঢুকে ফেললে, কারো সুগার ফল করলে বা কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে ইত্যাদি’
গত মে মাসে মিরপুরে বসবাসকারী আনোয়ারা বেগমের (৩৪) স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হন এবং দুই দিন প্রচণ্ড জ্বরে ভোগেন। তার জ্বর সেরে না যেতেই আনোয়ারা নিজেও অসুস্থ্য হন। এ সময় আনোয়ারা তার বৃদ্ধ শাশুড়ি ও দুই সন্তানের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং ভাবেন এটা কোনো সাধারণ জ্বর নয়, এটা করোনাভাইরাসের লক্ষণ হতে পারে। এ সময় তিনি বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন, কোন হাসপাতালে যাবেন কিংবা কোনো চিকিৎসকের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবেন।
তখন তার এক প্রতিবেশী তাকে ফোন করে বলেন, স্বাস্থ্য বাতায়নে যোগাযোগ করতে। আনোয়ারা বলেন, “স্বাস্থ্য বাতায়নে ফোন করে এভাবে সমস্যার সমাধান পাব ভাবতে পারিনি। ওই সময় সাধারণ ছুটির জন্য অনেক কিছু বন্ধ ছিল। হাসপাতালগুলোতে রোগী নিচ্ছিল না। ডাক্তাররা রোগী দেখছিলেন না। তাই আমি এত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম যে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারব। শুধু তাই নয়, তিনদিন পর আমার স্বামীর অবস্থা এতো খারাপ হয় যে স্বাস্থ্য বাতায়নে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও নিয়েছি। করোনার ওই দিনগুলোতে এতো সহজে সমাধান পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বাতায়নকে কখনো ভুলতে পারব না।
স্কুল শিক্ষক আরমান খান বলেন, “আমি যখন জুলাই মাসে করোনা পজেটিভ হই তখন কী করবো কিংবা কীভাবে চিকিৎসা করাবো বুঝতে পারছিলাম না। স্বাস্থ্য বাতায়নের বিষয়ে জানা ছিল। তাই সেখানে ফোন করি এবং সেখানকার চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নেই। তাদের কথায় ভরসা পেয়েছিলাম। তাই ভয় পাইনি। তখন বুঝতে পেরেছি এটি সরকারের একটি খুবই ফলপ্রসূ এবং ভালো উদ্যোগ।”
আসলে স্বাস্থ্য বাতায়ন কী? স্বাস্থ্য বাতায়ন সূত্রে জানা যায়, এটি জাতীয় টেলি হেলথ সার্ভিস যা ২০১৫ সালে চালু হয়। যুক্তরাজ্যের ইউকেএইড-এর আর্থিক সহায়তায় এর যাত্রা শুরু হলেও এখন পুরোপুরিভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপারেশন প্লানের সাথে এটা যুক্ত হয়ে সিনেসিস আইটির কারিগরি সহায়তায় কাজ করছে। এই হেল্পলাইনটির নম্বর হল ১৬২৬৩। যা সপ্তাহের ৭ দিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এখানে ফোন করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা পাওয়া যায়। এছাড়া এখান থেকে সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তারদের তথ্য কিংবা স্বাস্থ্য বিষয়ক অন্যান্য যে কোনো তথ্য এবং ফোন নম্বর পাওয়া যায়। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা বা হাসপাতাল বিষয়ক যে কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে এই নম্বরে জানানো যায়। সেই অভিযোগ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয় এবং সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলে অভিযোগকারীকে তা জানিয়ে দেয়া হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশকে সার্থক করে তুলতে এ উদ্যোগ যথার্থ। যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ে চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য এরকম ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা সত্যিই অনেক উপকারী। এই করোনাকালীন সময়ে মানুষ যখন সহজে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না বা ডাক্তার দেখাতে পারছে না তখন এ ধরনের হেল্পলাইন মানুষকে অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে। অনেক সময় ছোটখাট সমস্যায় মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখনও এ হেল্পলাইন ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
ভাবে কাজ করে স্বাস্থ্য বাতায়ন জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বাতায়নের সমন্বয়কারী ডা. দীপশিখা সাহা বলেন, “সাধারণত কেউ ফোন করলে তার সমস্যা শুনে আমরা তাকে জরুরি ভিত্তিতে যা প্রয়োজন তা করে থাকি। যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে তাকে হাসপাতালে যেতে হবে বা সরাসরি ডাক্তার দেখাতে হবে বা তার কোনো পরীক্ষা করা প্রয়োজন তখন আমরা তাকে সেসব কাজ করার পরামর্শ দেই। এক্ষেত্রে তাদেরকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করতে বলি। প্রয়োজনে তাদেরকে ঠিকানা বা ফোন নম্বর দিয়ে সাহায্য করি। কমবেশী সব বিষয়ে মানুষ এখানে ফোন করে। তবে সাধারণত মা ও শিশু বিষয়ক, যে কোনো ক্রনিক রোগ, মানসিক সমস্যা বা যে কোনো ছোটখাট দুর্ঘটনা ইত্যাদি বিষয়ে ফোন বেশি আসে। সারা দেশের এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও এখানে মানুষ ফোন করেন। আমরা এখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও দিয়ে থাকি। এছাড়া ৯৯৯-এর জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসটিও আমরা দিয়ে থাকি। কাউকে স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে দেখানোর প্রয়োজন হলে আমরা হাসপাতালের মাধ্যমে তাকে সে ব্যবস্থা করে দেই। এখানে মানসিক সমস্যার কাউন্সিলিংও করা হয়।”
স্বাস্থ্য বাতায়নের কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. মৃত্তিকা মাহজাবিন বলেন, “এখানে সব ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে মানুষ ফোন করেন। তবে জরুরি কলগুলো বেশি আসে। যেমন গর্ভবতী অনেক মা বুঝতে পারেন না তারা কীভাবে খাবার খাবেন বা ডাক্তারের কাছে কোন কোন সময় যাবেন, কখনও হঠাৎ শিশু কিছু খেয়ে ফেললে, নাকে কিছু ঢুকে ফেললে, কারো সুগার ফল করলে বা কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে ইত্যাদি। বাড়িতে কেউ অজ্ঞান হলে তারা হয়তো মনে করেন স্ট্রোক করেছেন। এসব ক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করি এবং সে অনুযায়ী তার পরিস্থিতি বুঝে তাকে পরামর্শ বা চিকিৎসা সেবা দেই।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে কারও স্বাস্থ্যগত সমস্যা শোনার পর আমরা একটি প্রেসক্রিপশন করে তার মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেই। সেই প্রেসক্রিপশনের নিচে যে ডাক্তার তার সাথে কথা বলেন তার নাম এবং তার বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি দেয়া থাকে। অনেক সময় দেখা যায় ঐ রোগী যদি আবার কোনো সমস্যায় পড়েন তখন তিনি যার মাধ্যমে সেরে উঠেছেন বা সেবা নিয়ে ভালো হয়েছেন তাকে চান। কেউবা শুধুমাত্র ধন্যবাদ দেয়ার জন্য আমাদের ফোন করেন। এসব ঘটনা আমাদের অনেক অনুপ্রেরণা দেয়। মনে হয় মাত্র পাঁচ মিনিটে একজন মানুষকে না দেখে শুধুমাত্র তার কথা শুনে তার জরুরি অবস্থা বোঝাতে পারছি বা এভাবে সেবা দেয়ায় তারা উপকৃত হচ্ছেন বিষয়টি ভাবতেই একটা অন্যধরনের ভালোলাগা অনুভূতি কাজ করে। আমাদের শহুরে জীবনে ডায়রিয়া এখন ভয়ানক কিছু নয়। কিন্তু অনেক গ্রামের মানুষ এখনও ডায়রিয়া হলে ভয় পান। তারা যখন এ বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে সেবা পান তখন বিষয়টিকে তারা অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রতিদিন এ ধরনের নানা ঘটনা ঘটে। যদিও কাজটি আমরা ফোনের মাধ্যমে করি তবুও মনে হয় আমরা সব সময় একটি চলমান হাসপাতালে কাজ করছি।”
করোনাকালে স্বাস্থ্য বাতায়ন কীভাবে কাজ করেছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বাতায়নের সিইও ডা. নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, “স্বাস্থ্য বাতায়নের লক্ষ্য হলো জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করা। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করছে। গত বছর এখান থেকে ১ কোটি ১৬ লাখ মানুষকে সেবা দেয়া হয়েছে। মার্চ থেকে মে মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত ১ কোটি ১৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৫ জন মানুষ সেবা নিয়েছেন। এর শতকরা ৭০ ভাগ করোনা সম্পর্কিত। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত ছিলেন শতকরা ৬২-৭০ ভাগ। এখন কল আসে যাদের তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ করোনা পজেটিভ। যারা বাসা থেকে সেবা নিচ্ছেন। শুরুর দিকে হাসপাতালগুলো বন্ধ থাকায় এটি ডিজিটাল হাসপাতালের কাজ করেছে বলে অনেকেই বলছেন।”
তিনি আরও বলেন, “২০২০ সালে দিনে ৫০-৯০ হাজার মানুষ সেবা নিত। যা গড়ে ৪০ হাজারের মতো। এখন কল আসে ১২-১৫ হাজার। করোনাকালে আমরা অনেক মানুষকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছি। এমনকি কারো কারো বাসায় ওষুধও পাঠিয়েছি। এগুলো নাগরিক সেবা। অনেকে কোভিডের সময় এখান থেকে মানসিক সাপোর্টও পেয়েছে। এখানে ৩০০ ডাক্তার কাজ করেন। কোভিডের সময় আগস্ট-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৪৫ জন ডাক্তার প্রতিদিন কাজ করেছেন। এখন দিনে ৪৫ জন ডাক্তার কাজ করেন। এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিরাট সহায়তা। ফেসবুকে আমাদের ৩ লাখ অনুসারী আছেন। যারা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন করেন বা তথ্য কিংবা পরামর্শ চান যা তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া হয়। আমাদের একটি স্লোগান আছে- ‘হাতে মোবাইল মানে ডাক্তার সাথে’।”
সত্যিই তাই- বললেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, “এটি সরকারের একটি খুবই ভালো এবং কার্যকরী উদ্যোগ। করোনাকালীন সময়ে তারা যথেষ্ট করছে। আমি যখন জুন মাসে এবং আগস্টে দুইবার করোনায় আক্রান্ত হই তারা নিজেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছে। ওই সময় পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল এবং অনেক কিছু বন্ধ ছিল। কিন্তু তারা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। এরপর আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যখন করোনা আক্রান্ত হন তখনও তারা আমার পাশে ছিল। আমি শুনেছি তারা অনেক মানুষকে ওষুধ পাঠিয়েছে। বাজারও করে দেয়ার কথাও শুনেছিলাম।”
ডিজিটাল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ সেবার বিষয়ে মানুষ ততটা জানেন না। বিশেষ করে অসহায় অবস্থায় পড়া যে কোনো মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য এ সেবা যথার্থই আলাউদ্দীনের চেরাগের মতো কার্যকর। যা তাদের স্বস্তি ও সাশ্রয়ে অনেক উপকার বয়ে নিয়ে আসবে এমনই ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না
মতামত দিন