দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সৌরবিদুতের ব্যবহার শুরু করেছে এবং সুফল পাচ্ছে। এটি যে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেটা যে আমাদের নজরে এসেছে এবং এ বিষয়ে কাজ চলছে এটাই আগামীতে অনেক বড় সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে
কুড়িগ্রামের কাঠালবাড়ি পেরিয়ে ছোট্ট ধরলা নদীর পাড়ে সোরাডোব চর। সন্ধ্যা হলে সেখানকার ছোট ছোট ঘরগুলোতে মিটমিট করে আলো জ্বলে। শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সকলেই দোকানে ভিড় জমায় টেলিভিশনে খবর দেখার জন্য। রাস্তায় টর্চের আলোর বদলে জ্বলে ওঠে সড়কবাতি। দিনের বেলায় গরমে অস্থির হয়ে এখন আর কেউ শরীরে ভেজা কাপড় পেঁচিয়ে রাখে না। চরের গনগনে উত্তাপে নদীতে বেশি সময় ধরে গোসলও করে না আজকাল কেউ। ঘরে পাখার বাতাসে আরাম করে বসে কাজ করে অনেকে। মুঠোফোনে চার্জ দেয়ার জন্য নদী পেরিয়ে এখন আর কাউকে অসময়ে বাজারে যেতে হয় না। সবচেয়ে খুশি তারা জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য তাদেরকে এখন আর ডিজেলের অংক কষতে হয় না। তারা বলছেন, “এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে সৌরবিদুতের জন্য। দুর্গম এ চরে কখনো বিদ্যুতের মতো আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাবো তা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। মনে হচ্ছে, এবার আমাদের দিন বদল হবে। বহু কষ্টের পর আমরা আরাম পাচ্ছি এবং আশা করছি আমাদের আরো উন্নতি হবে।”
চরাঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব প্রান্তিক মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করে তোলা হচ্ছে এবং পাল্টে যাচ্ছে তাদের কঠিন জীবনধারা। বিদ্যুৎ উন্নয়নের সূচক দুর্গম চরাঞ্চল কিংবা প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ সত্যিই আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এতে তাদের বহু সমস্যা কেটে গিয়ে আশা জাগাচ্ছে মনে। এই সৌরবিদ্যুৎ আসলে কি? সৌরবিদ্যুৎ সাধারণত খোলা জায়গায় আকাশের দিকে তাক করে রাখা একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্যানেলে তৈরি হয়। সূর্যের কিরণে যে শক্তি আছে সেই শক্তি প্যানেলে রাখা পলিক্রিস্টাল বা মনোক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি ছোট ছোট সেলগুলো ফটো ভোটেক্স পদ্ধতিতে চার্জ হয়ে তা বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর হয়। সহজ কথায় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত হয় সৌরবিদ্যুৎ। এটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবেও পরিচিত। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হল- গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের উপর নির্ভরশীলতা কমানো। এতে কমে যাবে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি।
এটি প্রধানমন্ত্রীর “সবার জন্য বিদ্যুৎ” বা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার একটি। এই কর্মসূচি চলতি ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে শতভাগ কার্যকর করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি চরাঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি কিংবা সৌরবিদ্যুৎকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। সরকারের পরিকল্পনা শতকরা ১০ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে আসবে। এজন্য বেসরকারিভাবে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ থেকেও বিদ্যুৎ কিনছেন সরকার। ২০১৭ সালে জামালপুরের সরিষাবাড়ির শিমলা বাজারে ৮ একর জমির উপর গড়ে তোলা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যেখান থেকে ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাচ্ছে। এই সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি গড়ে তুলেছেন “এনগ্রিন সোলার প্লান্ট লিমিটেড”।
প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প ম্যানেজার আনোয়ারুল কবির বলেন, “বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উপৎপাদন করে এভাবে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ করার বিষয়টি দিন দিন বেড়ে যাবে। এতে যেমন বিদ্যুৎ খাত এগিয়ে যাবে তেমনি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং এতে সরকার ও জনগণ নানাভাবে উপকৃত হবেন।” এভাবে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ টেকনাফ থেকে ২০ মেগাওয়াট, কাপ্তাই থেকে ৭.৮ মেগাওয়াট এবং পঞ্চগড় থেকে ১০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।
কোথায় কোথায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা সম্ভব জানতে চাইলে সোলার সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান “সোলারএন বাংলাদেশ লিমিটেড”-এর টেকনিক্যাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার শাহীন আজাদ বলেন, “এটা শুধু বাসা-বাড়ি বা অফিস ফ্যাক্টরিতে নয়, নানাভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে। সোলার ইরিগেশন, সোলার ওয়াটার হিটার, সোলার ড্রিংকিং ওয়াটার সিস্টেম, বায়োগ্যাস প্লান্ট, ইমপ্রুভড কুক স্টোভ, সোলার স্ট্রিট লাইট, সোলার টেলিকম টাওয়ার হিসেবেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে।”
সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারে পাল্টে যাচ্ছে কৃষিচিত্র। সৌরবিদ্যুৎ চালিত পাম্পের মাধ্যমে অল্প খরচে কৃষকরা জমিতে পানি দিতে পারছেন। এসব জমিতে তারা ধান, আলু শাকসবজি আবাদ করছেন। কৃষকরা বলছেন, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেচপাম্পে চাষাবাদ করে তারা খরচ ও সময় দুটোই সাশ্রয় করছেন। লোডশেডিংয়ের হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়ায় তারা অনেক খুশি।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কৃষক হাবিব মিয়া বলেন, “আমন, বোরো ও রবি তিন ফসলেই সৌরশক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচ থেকে পানি ওঠাচ্ছি। বোরো মৌসুমে লোডশেডিং বেশি হয় বলে সেচ কাজে অনেক সমস্যা হয়। আবার ডিজেলের দামও বেশি থাকে। কিন্তু সৌরবিদ্যুৎ থাকায় এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে হয় না। বরং এতে খরচও অনেক কম হচ্ছে।”
যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে মানুষ বৈদ্যুতিক বাতি, টেলিভিশন, ফ্যান, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। মুঠোফোনে চার্জ দিচ্ছে, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করছে। সড়কবাতি জ্বলছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সোলার বাতি জ্বলছে। সৌরবিদ্যুত চালিত নলকূপ থেকে পানিও তুলছেন তারা।
সৌরবিদুতের এত ব্যাপক ব্যবহারে বিপুল সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে এবং এটি মানুষকে অনেক আশাবাদী করে তুলছে। এটা ধরে রাখতে এর ব্যবহার বাড়ানো হলে পরিবেশ ও জনজীবনে অনেক স্বস্তি এবং শান্তি আসবে। ঢাকাবাসী কি এর সুফল পেতে পারে? ঢাকা শহরে যেভাবে দূষণ বাড়ছে তাতে এ শহরে বাস করা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে এমনই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার বাতাস সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি দূষিত। পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা “গ্রিন পিস”-এর ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, যা দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রায় ৫ শতাংশ।” ঐ একই প্রতিবেদন জানায়, “বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকালমৃত্যু হয়েছে।”
আর এ জন্যই কথা উঠেছে ঢাকা শহরের দূষণ কমাতে কিংবা পরিবেশ রক্ষার জন্য গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি। সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করে সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান “সাসটেইনবেল অ্যান্ড রিনিউবেল এনার্জি ডেভলপমেন্ট অথরিটি (স্রেডা)” এবং “ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)” জানায়, অনেক দেশেই ইলেকট্রিক গাড়ি আছে। সেগুলো ব্যয়বহুল। এতে দূষণ কম হয়।
ইডকলের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স-এর ইউনিট হেড নাজমুল হক ফয়সাল বলেন, “আমরা নৌকা ও ভ্যানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করার কথা ভাবছি। এ বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক কাজও হচ্ছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ব্র্যাকের অ্যাম্বুলেন্সেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে গাড়ির বিষয়টি নিয়েও ভাবতে চাই আমরা।”
স্রেডার (সোলার-২) সহকারি পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার পাভেল মাহমুদ বলেন, “গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না। সৌরবিদ্যুৎ চালিত চার্জ স্টেশন থাকতে পারে। সেখানে গাড়ি চার্জ নিতে পারে। যদিও অটোরিকশাগুলো সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ব্যাটারিতে চার্জ নিয়ে অনেক জায়গায় চলছে, এরকম কিছু হতে পারে। গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে আমরা গাইডলাইন তৈরি করছি।”
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং বায়ু দূষণ গবেষক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বলেন, “এটা হলে ভালো হতো। অনেক উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকেই জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ হয়েছে। ফলে সেখানে দূষণ কম হয়। গাড়িতে ব্যাটারি চালিত বিদ্যুৎ হোক বা সৌরবিদ্যুৎ চালিত বিদ্যুৎ থেকে চার্জ নিয়ে হোক না কেনো, যেটাই হোক এটা হলে দূষণ অনেক কমে যাবে। এখানে আমরা নিন্মমানের জ্বালানি ব্যবহার করি। যেমন উন্নত বিশ্বে জ্বালানিতে ব্যবহৃত সালফারের মাত্রা ৫০ এর নিচে থাকে। ঢাকায় সেই মাত্রা ২০০০-এর কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারে অনেক সাশ্রয় এবং পরিবেশবান্ধব হবে।”
এ বিষয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনার বিষয় রয়েছে। এতে জ্বালানির ব্যবসা কমে যাবে। ফলে আরেক সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এতে কতটা রাজি হবেন সেটাও ভাবার বিষয় জানান অধ্যাপক সালাম। তবে বৃহত্তর স্বার্থে এবং দূষণ রোধে এ ধরনের প্রচেষ্টা যেমন নানা রোগব্যধিকে দূরে রাখতে পারবে, তেমনি গ্রিন পিসের তথ্য অনুয়ায়ী জাতীয় অর্থনীতির নেতিবাচক দিক বা জিডিপিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে অভিজ্ঞজনেরা মত প্রকাশ করেন।
দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সৌরবিদুতের ব্যবহার শুরু করেছে এবং সুফল পাচ্ছে। এটি যে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেটা যে আমাদের নজরে এসেছে এবং এ বিষয়ে কাজ চলছে এটাই আগামীতে অনেক বড় সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে এমনই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সকলের।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না
মতামত দিন