দেশের পলিসি হওয়া উচিত তথ্যভিত্তিক, ইমোশনের ভিত্তিতে নয়। তাই সবকিছু বিবেচনায় আনা সময়ের দাবি। স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা উপর জোর দিয়ে পর্যাক্রমিকভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রথমে ঢাকার বাইরের স্কুলগুলো সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা যেতে পারে
গত মার্চ থেকে সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সেটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং জনস্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে সে সময় সোচ্চার ছিলাম। মার্চের শুরুর দিকে সন্তানদের স্কুলের ম্যানেজমেন্টকে অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছিলাম কোভিডের বিষয়টি। ঢাকার সেই প্রাইভেট স্কুল স্টুডেন্টদের স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সম্ভবত প্রথমে স্কুল বন্ধ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
করোনাভাইরাসের শুরুতে মানুষ অত্যন্ত আতংকগ্রস্ত ছিল। এ কারণে দেখা গেছে লাশ ফেলে রাখতে, সন্তানরা চলে গেছে বাবা-মাকে রেখে। গ্রাম থেকে কোভিড রোগী সন্দেহে পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সবার মধ্যে এক ধরনের মৃত্যুর আতংক জেকে বসেছিল। সঙ্গত কারণে লোকজন কিছুদিন ঘরে অবস্থান করে। কিন্তু এ অবস্থা গত ঈদুল ফিতর থেকে বড় রকমের পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়। গুগলের মোবিলিটি ডাটা অনুযায়ী দেখা যায়, মানুষের বাইরে চলাফেরা করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে যেমনটি ছিল, বর্তমানে সে অবস্থায় চলে এসেছে (ছবিতে দেখুন, খেয়াল করুন শুরু এবং শেষের দিকে যাতাযাতের অবস্থা বা ট্রেন্ড)। মানুষের মেলামেশা, বাইরে যাওয়া, বাজারে যাওয়া বন্ধ নেই। ছবির সবুজ লাইনটি হচ্ছে ঘরে আবদ্ধ থাকা মানুষের মোবিলিটি বা সক্রিয়তা। সবকিছু স্বাভাবিক লেভেলে এসেছে বলে সেই লাইনটি ক্রমশ অবদমিত হয়েছে।
মাসভিত্তিক মানুষের চলাচল বৃদ্ধির চিত্র। সৌজন্য
মাস-ভিত্তিক মানুষের সক্রিয়তার গ্রাফ (করোনার লকডাউন শুরু থেকে জানুযারি পর্যন্ত) বিভিন্ন ধরনের মুভমেন্ট বা সক্রিয়তা (অফিস, বাজারঘাট, বিনোদন সংক্রান্ত) চিত্র ফুটে উঠেছে। স্মার্টফোন উপর ভিত্তি করে গুগুল বিশ্বব্যাপী মোবিলিটি ডাটা সংগ্রহ করে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলো কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে?
করোনাভাইরাস মাহামারি নিয়ে যে সমস্ত দেশ আলোচনায় এসেছে দেশ যেমন- ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলসহ অনেক দেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এসব দেশ পর্যাক্রমিক (ফেইজ বাই ফেইজ) খুলে দিচ্ছে। অনলাইন সার্চ করলে সহজে এসব তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশেরও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
দেশে অনলাইনের শিক্ষা কি ঠিক মত চলছে?
ঢাকার অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান (বিশেষ করে বেসরকারি) অনলাইনে সিস্টেম প্রায় রপ্ত করে ফেলেছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে অনলাইনে ঠিকমত ক্লাস হচ্ছে না বিভিন্ন সমস্যার কারনে। তাছাড়া গ্রাম লেভেলে তেমন কার্যক্রম নেই। এতে শিক্ষকরাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। স্টুন্ডেন্টরাও বখাটেপনার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, হতাশাগ্রস্ত হয়েও পড়ছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম না থাকার কারনে অনেক বেসরকারি স্কুল (বিশেষ করে কিন্টারগার্টেন লেভেলে) বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ঠিকমত বেতন পাচ্ছেন না; অনেকের চাকরি চলে গেছে। অনেক স্কুল চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে। তাদের অবস্থা বা মনোভাব পত্রিকায় বা সোস্যাল মিডিয়াতে তেমন পাওয়া যায় না। দেশের এই বড় অংশকে বঞ্চিত করে পলিসি গ্রহণ করা কি ঠিক হবে?
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কেন খুলে দেওয়া প্রয়োজন?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার মূল কারণ ছিল পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদেরকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করা, কেন না তাদের ওপর করোনাভাইরাস প্রভাব মারাত্নক প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের লোকজন চাকুরির তাগিদে, বাজারে, বেড়াতে, নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাচ্ছে। মাদ্রাসাগুলোতেও রীতিমত ক্লাস হচ্ছে। গুগলের মোবিলিটি ডাটা হচ্ছে যার প্রমাণ। করোনাভাইরাসের ভয়ে একসময় হাসপাতালগুলো বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন তা আগের মত অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র করোনাপূর্ববর্তীতে সময়কার মত জনাকীর্ণ। অর্থাৎ সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আমরা কি কিছু অর্জন করতে পারব? এতে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত কি হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছেন না? দেশের বড় একটি অংশ কি বঞ্চিত হচ্ছে না? গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারনে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে যারা পড়াশুনায় ফিরতে পারবে না। যদিও নির্দিষ্ট বয়সের আগে বিয়ে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তা অহরহ হচ্ছে যেমনটি দুর্নীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেক স্টুডেন্ট গার্মেন্টস, কৃষিকাজ এবং ব্যবসায় জড়িত হওয়ার কারণে পড়াশোনায় তারা আর ফিরবে না। দেশে পলিসি হওয়া উচিত তথ্য-ভিত্তিক, ইমোশনের ভিত্তিতে নয়। তাই সবকিছু বিবেচনায় আনা সময়ের দাবি।
স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা উপর জোর দিয়ে পর্যাক্রমিকভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রথমে ঢাকার বাইরের স্কুলগুলো সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, গণস্বাস্থ্য গবেষক, নির্বাহী পরিচালক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ এবং সহযোগী অধ্যাপক, ইন্ডিপেনডেন ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন