ইসলামোফোবিয়া সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে যতটা রাজনৈতিক, তারও চেয়েও বেশি অর্থনৈতিক। তাদের চোখে এটা কেবলই সম্পদ লুন্ঠন ও অস্ত্র বাণিজ্যের সহজলভ্য হাতিয়ার মাত্র, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে নতুন মাত্রায়, আর অকাণেই প্রাণ দিতে হচ্ছে শত-সহস্র নিরপরাধ মানুষকে
আজকের দুনিয়ায় “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি একটি “বাজ ওয়ার্ড”। অক্সফোর্ড ডিকশনারির সংজ্ঞা অনুযায়ী ইসলামকে সবার সামনে ভীতিকর করে উপস্থাপন করাই হচ্ছে “ইসলামোফোবিয়া”। ইসলামোফোবিয়ার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকের কাছেই ইসলাম একটি ভীতিকর শব্দ, তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মানেই সন্ত্রাসী-উগ্রপন্থী।
মুসলমানদের এই বর্বর-সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচয়ের কারণেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী মৃত্যুবরণ করলে অথবা বৈষয়িক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হলে অনেকেই আনন্দিত হয়, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলে অনেকেই তাতে সমর্থন দেয়। “গোয়েবলস” এর “প্রোপ্যাগান্ডা” তত্ত্বমতে একটি মিথ্যাকে বারবার প্রচার করা হলে সেটিই সবার কাছে সত্য বলে গ্রহণীয় হয়। আর দর্শকদের এই মহজধোলাইকে সহজ করে দেয় কিছু “বায়াজড মিডয়া”, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কিছু গণমাধ্যমের ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদের একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় তারা ৯৪.১২% নিউজ করে থাকে “এন্টি-ইসলামিক সেন্টিমেন্ট” উসকে দেওয়ার জন্য। এসব সংবাদ দেখে দর্শকরা ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম মনে করবে সেটাই স্বাভাবিক। ইসলামোফোবিয়া হল ইসলামের বিপরীতে ভীতি সৃষ্টি করে যুদ্ধ, লুটপাট ও গণহত্যার সমর্থন আদায় করার একটি সহজ পদ্ধতি ।
ইসলামোফোবিয়া যতখানি না রাজনৈতিক তার থেকেও বেশি অর্থনৈতিক। ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে মাল্টি মিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি । Council on American-Islamic Relations (CAIR) এবং University of California এর একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের ভেতরে শুধুমাত্র মার্কিন মুলুকে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর জন্য ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে, বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ১,৬৭৮ কোটি টাকারও বেশি! Center for American Progress ইসলামোফোবিক ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা এবং দাতাদের সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য স্বচ্ছ ভাবে তুলে ধরেছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হল এটা শুধু আমেরিকান ইসলামোফোবিক ইন্ডাস্ট্রির চিত্র, বিশ্বজুড়ে এই চিত্র কেমন হতে পারে তা অনেকটাই অজানা।
ইসলামোফোবিয়ায় মার্কিন মূলকে বিনিয়োগের ফলশ্রুতিতে জনমনে ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। নোয়াম চমেস্কির ভাষায় এটা হচ্ছে “মনোজাগতিক উপনিবেশ” । CNN এর তথ্যমতে শুধুমাত্র ২০১৪-১৫ সালেই মার্কিন মুলুকে ইসলাম বিদ্বেষী “হেইট ক্রাইম” বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৭%। কানাডায় ২৫৩%, লন্ডনে ৪০%। জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, চায়নাসহ ইউরোপ ও আমেরিকার অন্যান্য দেশে একই অবস্থা। আল-জারিরার একটি অনুসন্ধানী দল দেখিয়েছে মার্কিন ইসলামোফোবিক ইন্ডাস্ট্রির পেছনে রয়েছে প্রায় ৭৪টি সংস্থা এবং তাদের পোষ্য গণমাধ্যম।
৯/১১ পরবর্তীতে সৃষ্ট ইসলামোফোবিয়ায় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫০%, শুধু হিজাব পরার কারণে উন্নত বিশ্বে ৬৯% মুসলিম নারী বৈষম্যের শিকার হয়, মুসলিম হওয়ার কারণে বেকারত্বের সম্ভবনা বৃদ্ধি পায় ২৯%! এসব পরিসংখ্যান সেইসব দেশের যারা বিশ্বজুড়ে সবাইকে অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার শেখায়!
এবার আসা যাক ইসলামী উগ্রপন্থী জঙ্গিদের প্রসঙ্গে। জঙ্গিবাদ নিঃসন্দেহে চরম অমানবিক ও মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী পন্থা। ইসলামতো নয়ই , পৃথিবীর কোনো ধর্মই জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না । তবে জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে পৃথিবীর স্বঘোষিত কিছু মানবতাবাদীরা। তারাই এসব জঙ্গি সংগঠনের স্রষ্টা, তারাই অস্ত্র সরবরাহকারী এবং অর্থনৈতিক মদদদাতা। মার্কিন মোড়লেরা “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ঘোষণা করলেও সিরিয়ান বিদ্রোহীদের কাছে সৌদির হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের ৪০,০০০ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ। তালেবানদের হাতে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে রাশিয়া। আইএস জঙ্গিদের কাছে অস্ত্র সরবারহ করে রাশিয়া, চীন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ সমূহ। আল-নুসরা, আল-কায়েদাকে মদদ দেওয়ারও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। “সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে বিষ ঝাড়া” এই প্রবাদটি কে প্রচলন করেছিলেন সেটা জানা নেই, তবে তিনি বোধহয় স্বঘোষিত এইসব মানবতাবাদীদের কীর্তিকলাপ দেখেই এই প্রবাদের প্রচলন করে থাকবেন।
৬ অক্টোবর ২০১৬। এই দিনটিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম INDEPENDENT একটি সাড়াজাগানো সংবাদ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল, “US government spent over $ 500m on fake Al-Qaeda propaganda videos that tracked location of viewers. The Pentagon hired a UK-based PR firm to produce and disseminate videos during the Iraq War” এই প্রতিবেদনে বলা হয় , ইরাক যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লন্ডনভিত্তিক একটি পিআর (পাবলিক রিলেশন) ফার্মকে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার নামে ফেক প্রোপ্যাগান্ডা চালানোর জন্য প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে (আজকের বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্যমান ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি)।
“The Bureau of Investigative Journalism” নামক একটি সংস্থার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। “Abigail Fielding-Smith” নামের এক সাংবাদিক বিভিন্ন নথি-পত্রের উপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই প্রতিবেদনে লন্ডনভিত্তিক একটি পিআর ফার্মের Bell Pottinger নামের ভিডিও নির্মাতার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। এই সাক্ষাৎকারে Bell Pottinger জানান, তৎকালীন সময়ে তিনি উক্ত পিআর ফার্মের হয়ে আল-কায়েদার ফেক ভিডিও নির্মাণ করে, যে ভিডিওতে দেখানো হয় আল-কায়েদার জঙ্গিরা মার্কিন নাগরিকদের জিম্মি করে রেখেছে ও হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এই ভিডিওর কিছু অংশ ধারণ করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর কিছু অংশ ধারণ করা হয় ইরাকের মরুভূমিতে।
শুধু এ রকম ভিডিও নয়, ইরাক হামলার ধ্বংসযজ্ঞ আড়াল করার জন্য মার্কিন সেনারা ইরাকি মিডিয়াকে নিয়মিত অর্থ প্রদান করত এবং ওইসব মিডিয়াতে যে সংবাদ প্রকাশ করা হতো তা মূলত মার্কিন সেনারাই লিখে দিত। এ বিষয়ে Los Angeles Times ২০০৫ সালে আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।
ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে এই কাল্পনিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ইরাকে আক্রমণ চালানো হয় এবং পরে তা আরও জোরদার করা হয়। ইরাক অগ্রাসনে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৪ লাখ মানুষ। আর যুদ্ধ শেষে জানা যায় ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নিশানাও ছিল না! অকারণে প্রাণ যায় নিরাপরাধ ২৪ লক্ষ মানুষের। ইরাক অগ্রাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের তেল সম্পদ লুন্ঠন।
বিশ্ব নিয়ন্ত্রকদের জন্য ইসলামোফোবিয়া একটি সহজলভ্য হাতিয়ার। ইসলামোফোবিয়ার মাধ্যমে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মাধ্যমে তেল সম্পদ লুট করা হচ্ছে। পৃথিবীর মোট খনিজ তেলের ৭৫% রিজার্ভ রয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে, আর আমেরিকায় রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ২% তেল। পেট্রো-ডলার অর্থনীতিতে তেল যার নিয়ন্ত্রণে, বিশ্ব তার নিয়ন্ত্রণে। যুদ্ধের সময় বেড়ে যায় অস্ত্র বাণিজ্যের অর্থনীতি, আর যুদ্ধ শেষে পাওয়া যায় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অবৈধ নিয়ন্ত্রণ। ইসলামোফোবিয়া সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে যতটা রাজনৈতিক, তারও চেয়েও বেশি অর্থনৈতিক। তাদের চোখে এটা কেবলই সম্পদ লুন্ঠন ও অস্ত্র বাণিজ্যের সহজলভ্য হাতিয়ার মাত্র, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে নতুন মাত্রায়, আর অকাণেই প্রাণ দিতে হচ্ছে শত-সহস্র নিরপরাধ মানুষকে।
ফজলে রাব্বী খান, প্রকৌশলী
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন