লজ্জাবতী বানর পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। বিভিন্ন গাছের বীজ তাদের বিষ্ঠার মাধ্যমে ছড়ায় বিধায় বনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এরা ব্যাপক ভূমিকা রাখে
বাধাহীন, নির্মল শান্তিতে কাটানো যে জীবনে আচমকা, কোভিড-১৯ উল্টেপাল্টে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে মানুষের চিরকালের চেনা জগত, সামাজিক বন্ধন ও অবাধ বিচরণ। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিয়ে মানুষ নতুন অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো কোভিড-১৯ থেকে এই শিক্ষাটা নিতে পেরেছি- প্রকৃতির সঙ্গে বিরূপ আচরণ মূলত আমাদের নিজেদেরই অস্তিত্ব বিপন্ন করার নামান্তর। যেহেতু চলমান সমস্যাটি মূলত প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত এবং বিশেষজ্ঞদের মতে ভাইরাসটি বনরুই নামে এক বন্যপ্রাণী থেকে মানুষে এসেছে, ফলে আমরা প্রকৃতির গুরুত্ব গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছি এবং প্রকৃতির মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।
কোভিড-১৯ এর আক্রমণ আমাদের করে তুলেছে আতঙ্কগ্রস্ত এবং এর ফলে অগণিত মৃত্যুর সংবাদ করে তুলেছে ভীত-সন্ত্রস্ত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এর মধ্যেই পরিবেশও বদলে নিচ্ছে নিজকে, নিজের প্রাকৃতিক নিয়মেই। চারদিকে এতো এতো দুঃসংবাদের মধ্যেও কিছু ঘটনা আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। যেমন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিপন্ন ডলফিনের বিচরণ এবং স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপস্থিতি যেগুলোর দেখা সচরাচর মেলে না, কারণ আমরাই। আমরা ভেবে দেখতে পারি নূন্যতম বিবেচনা ছাড়াই আমরা প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে চলেছি দিনের পর দিন। করোনাকালীন সময়ে পশু-পাখিদের অবাধ বিচরণে মনে হয় প্রকৃতি আবার তার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন বজায় থাকায় সব জায়গায় মানুষের অবাধ বিচরণ প্রায় বন্ধ। ফলে বিভিন্ন জায়গায় বেড়েছে বন্যপ্রাণীর বিচরণ এবং দেখা মিলছে বিপন্ন সব প্রাণীর। বানরের সঙ্গে পরিচিতি আমাদের মোটামুটি সবার থাকলেও লজ্জাবতী বানর আমাদের খুব কম মানুষের কাছেই পরিচিত। সুসংবাদ হচ্ছে সম্প্রতি কক্সবাজারের পর এবার রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছরি উপজেলায়ও লজ্জাবতী বানরের দেখা মিলেছে।
গত ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাস ভবনের পাশে একটি গাছে (অক্ষাংশ – ২২⁰৩৯.৫১০ মিনিট এবং দ্রাঘিমাংশ – ৯২⁰২৩.১৯৪ মিনিট) লজ্জাবতী বানরটি লক্ষ্য করেন স্থানীয় কিছু লোকজন। প্রাথমিকভাবে প্রাণীটি তারা চিনতে না পেরে উচ্ছ্বাসের তোড়ে হই-হুল্লোড় শুরু করে দেয়। অতি উৎসাহীরা ঢিলও ছোঁড়ে। অতিরিক্ত চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভয়ে লজ্জাবতী বানরটি গাছ থেকে নেমে একটি নিচু ল্যাম্প পোস্টের ওপর আশ্রয় নেয়। এরইমধ্যে ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত, বিপ্লব চাকমা নামে স্থানীয় এক ছাত্রের মাধ্যমে আমার কাছে প্রাণীটির ছবি আসে। আমি প্রাণীটির পরিচয় ও স্বভাব তাকে বর্ণনা করে, বানরটিকে উদ্ধার পূর্বক বড় গাছ আছে এমন কোনো জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেই।
অবমুক্ত করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বানরটিকে। ছবি: সৌজন্যআইইউসিএন বাংলাদেশ লাল তালিকা (২০১৫) অনুযায়ী পৃথিবীব্যাপী সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে লজ্জাবতী বানর বিপন্ন অবস্থায় টিকে আছে। এক সময় প্রাণীটি বাংলাদেশের চিরহরিৎ বনসহ দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের মিশ্র চিরসবুজ এবং চিরসবুজ বনে পাওয়া যেত। কিন্তু ১৯৮৭ সালের পর চিরহরিৎ বনে এটি আর পাওয়া যায় না। তবে দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের মিশ্র চিরসবুজ এবং চিরসবুজ বনে সংখ্যায় কম হলেও এরা এখনও টিকে আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এটি ভারত এবং ইন্দো-চায়নাতে বাস করে। লজ্জাবতী বানর বাংলাদেশের একমাত্র নিশাচর প্রাইমেট যেটি গাছের ওপর থাকতেই বেশি পছন্দ করে। দিনের বেলায় এরা আলো থেকে নিজেদের আড়ালে রাখার চেষ্টা করে এবং ঘুমায়, সন্ধ্যার পরেই খাবারের সন্ধানে বের হয়। এরা খুব আস্তে আস্তে চলাফেরা করে এবং কোনো শব্দ শুনলে চলাচল বন্ধ করে একেবারে থেমে যায়।
লজ্জাবতী বানরের দেহের রং গাঢ় বাদামী, মাথা গোলাকার চ্যাপ্টা, অপূর্ব বাদামী চোখ এবং ছোট কান। দেহে ধূসর বর্ণের পশমের একটি রেখা পিঠ বরাবর দেখা যায়। মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ২৬-২৮ সেন্টিমিটার এবং ওজন প্রায় ১.৫-২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি একটি সর্বভূক প্রাণী। বিভিন্ন গাছের বাকল, আঠা, রজন, পাতা, ফল, পোকামাকড় এবং পাখির ডিম খেয়ে জীবনধারণ করে। সাধারণত এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং নিজেদের এলাকা চিহ্নিত রাখে। লজ্জাবতী বানর নিজেদের মধ্যে এক ধরনের উচ্চমাত্রার শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে। এই বানরটি বছরে সাধারণত একটি করে বাচ্চা দেয়। কোনো কোনো সময় একাধিক বাচ্চাও জন্ম দিয়ে থাকে।
লজ্জাবতী বানর পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। বিভিন্ন গাছের বীজ তাদের বিষ্ঠার মাধ্যমে ছড়ায় বিধায় বনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এরা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাছাড়া অন্যান্য প্রাণীর যেমন অজগর ও ঈগলের খাবার হিসেবে লজ্জাবতী বানর দ্বিতীয় স্তরের খাদক হিসেবে ভূমিকা রেখে বাস্তুতন্ত্রের সাম্যাবস্থা বজায় রাখে। বনভূমি ধ্বংস এবং আবাস্থল ক্রমশঃ হ্রাস পাওয়াসহ নানাবিধ কারণে লজ্জাবতী বানর হারিয়ে যাবার পথে। উঁচু গাছ তাদের বেঁচে থাকার একটি অন্যতম নিয়ামক যা দিন দিন অপরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনার কারণে ধ্বংস করা হচ্ছে। এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্য একটি প্রধান কারণ হচ্ছে কিছু লোকজন দ্বারা ঔষধ এবং মাংসের জন্য লজ্জাবতী বানর অবৈধ শিকার।
জুরাছরি উপজেলা থেকে উদ্ধারকৃত লজ্জাবতী বানরটি স্থানীয় রুপান্তর দেওয়ানের নেতৃত্বে ঝন্তুময় দেওয়ান, বিপ্লব চাকমাসহ আরও অনেকে মিলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে কাছাকাছি একটি বৌদ্ধ বিহারের পেছনের জঙ্গলে অবমুক্ত করে।
তরুণ সমাজের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, বনভূমি রক্ষা, আইনের যথাযথ প্রয়োগে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায়ই পারে লজ্জাবতী বানরকে বাঁচিয়ে রাখতে। কোভিড-১৯ এর আগে লজ্জাবতী বানর খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল এই দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে। সম্প্রতি লকডাউনের কারণে বনে মানুষের আনাগোনা কম থাকায় নির্ভয়ে বের হচ্ছে এই বিপন্ন প্রাণীটি। করোনাভাইরাস যেহেতু বন্যপ্রাণী থেকে এসেছে তাই যে কোনো বন্যপ্রাণীর মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকাই মঙ্গল। যেটি পরবর্তীতে এ ধরনের যে কোনো অতিমারী মোকাবিলায় কার্যকরি পন্থা হিসেবে ভূমিকা রাখবে কারণ সামনে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।
সবশেষে, কোভিড-১৯সহ অন্যান্য কোনো অতিমারী কখনোই প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্য আশীর্বাদ নয়। কিন্তু এটি আমাদের জন্য এটি সতর্ক সূচক যা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি নির্মল নির্ভয় পরিবেশ উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করতে পারি।
সমীর সাহা, বন্যপ্রাণী গবেষক, আইইউসিএন-বাংলাদেশ ও এমফিল গবেষক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সমীর সাহা
মতামত দিন