করোনাভাইরাস মহামারী ইউরোপের প্রথাগত মৈত্রীর ধারনা ভেঙ্গে দিয়েছে
করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে আলাপের শেষ নেই। দুটি সম্ভাবনাকে ঘিরে এই আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে। প্রথমত, মার্কিনীদের আধিপত্য দুর্ভেদ্য থাকবে কিনা। দ্বিতীয়ত, চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা। তবে অনুমান করা যায় যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি একক কোন অঞ্চল বা দেশের পক্ষে থাকবে না। স্থায়ী বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির পূর্বে বিশ্ব স্বল্পস্থায়ী মিশ্র এক রাজনৈতিক শক্তির সাক্ষী হতে পারে। তবে বিশ্বের পরিবর্তনের অবয়বে অনিশ্চয়তা থাকলেও ইউরোপের কিছু পরিবর্তন অবশ্যাম্ভাবী মনে হচ্ছে। কারণ করোনা মহামারী ইউরোপের প্রথাগত মৈত্রীর ধারনা ভেঙ্গে দিয়েছে। ইতালি ও স্পেন করোনাভাইরাস মোকাবিলার যুদ্ধে কাউকে সাথে পায়নি। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংবিধানের বিরুদ্ধে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইতালি ও স্পেনের এই নিঃসঙ্গতা ক্রমবর্ধমান এক ক্ষয়িষ্ণু ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্দা উন্মোচন করেছে যার শুরু হয়েছিল ব্রেক্সিট ও উগ্র ডানপন্থীদের ইউরোপের মূলধারার রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। তাই করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী সময়ে কিছু মুখ্য পরিবর্তন এড়িয়ে যাওয়া ইউরোপের জন্য সম্ভভ নাও হতে পারে।
পুঁজিবাদি সভ্যতার মক্কা ইউরোপ কার্যত এখন অচল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপিয়ানরা জাতীয়তাবাদের রঙ দেখিয়ে সমগ্র দুনিয়াকে বিভক্ত করলেও অভ্যন্তরীণ সীমানা উপড়ে ফেলে এক অখণ্ড ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করেছিল। গত অর্ধশতক ধরে পশ্চিমা সভ্যতার বড় বিজ্ঞাপন এই অখণ্ড ইউরোপিয়ান ভূমি। ন্যাটো প্রতিরক্ষা আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাজনৈতিক কাঠামোর প্রধান অনুঘটক হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্যেকে প্রায় থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ব্রেক্সিটের পর করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মহামারী আবার সেই অভ্যন্তরীণ বিবাদকে উস্কে দিয়েছে কিংবা বিবাদের পথ উন্মুক্ত করেছে। ইতালি ও স্পেনকে মহামারীর মুখে ঠেলে দিয়ে প্রায় এক ডজন ইউরোপীয় দেশ নিজস্ব সীমানা বন্ধ করেছে এবং– শেঙ্গেন (Schengen) মুক্তাঞ্চলও বর্তমানে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তবে যখন ইউরোপিয়ানরা একে ওপরের জন্য সীমানা সিলগালা করতে নিবিষ্ট তখন ইতালি আর স্পেনসহ আক্রান্ত অঞ্চলের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে রাশিয়া, চীন আর কিউবা।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে প্রকাশ, ইউরোপীয় দেশসমূহের অসহযোগিতার কারণে ইতালি করোনা মহামারীর থেকে নিষ্কৃতি পেতে সাহায্যের আবেদন করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছে। মানবিক এই আবেদনে সাড়া দিয়ে গত কয়েকদিনে অন্ততপক্ষে ১৫টি রাশিয়ান সামরিক বিমান রাশিয়ান ত্রাণ নিয়ে ইতালিতে পৌঁছেছে। বিমানগুলোতে আটটি মেডিকেল ব্রিগেডসহ একশো স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন যাদের অধিকাংশই রাশিয়ার জৈবিক ও রাসায়নিক প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ করেন। রাশিয়ানদের পাশাপাশি কয়েক ডজন কিউবান ও চায়নিজ মেডিকেল টিম কাজ করছে ইতালিতে। আর এই সকল কিছুই সম্ভব হয়েছে ইতলির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তের একান্ত অনুরোধে। দশকের পর দশক আদর্শিক মতবিরোধের দরুন রাশিয়া এবং কিউবাকে কঠোর পশ্চিমা অবরোধ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই অবরোধ রাশিয়া এবং কিউবাকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে বারংবার। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় ইউরোপিয়ানদের অসহযোগিতার দরুণ ইতালিকে এক সময়ের বিরোধীদের উপর ভর করতে হচ্ছে।
তবে দেরীতে হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তাদের ঘুম ভেঙ্গেছে। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের খবর প্রকাশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তারা মহামারী নিরোধে করনীয় সম্পর্কে বৈঠকে বসেছেন। বৈঠক থেকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে কিভাবে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া যায় সেই সম্পর্কিত একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হাজির করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিধাতাই একমাত্র ভাল জানেন যে আগামী দুই সপ্তাহে ইতালি ও স্পেনের গোরস্থানের পরিধি কতটা প্রশস্ত হবে। নীতি নির্ধারণী ওই বৈঠকে ফ্রান্স এবং ইতালির পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে একটি প্রণোদনা প্যাকেজ, “করোনা বন্ড” চালু করার আবেদন ছিল যেখান থেকে সকল সদস্য রাষ্ট্র সহযোগিতা পাবে। কিন্তু ইউরোপের জাতীয় জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং করদাতাদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল অস্ট্রিয়া এবং নেদারল্যান্ডের নেতাদের সমার্থনে ওই প্রস্তাব বাতিল করে দেন। বিভক্তি নিয়েই শেষ হয়েছে বৈঠক
আদতে গত এক দশক ধরেই ইউরোপের দেশসমূহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্ত। নেই ঐকমত যেমনটা ছিল ইরাক ও আফগানিস্থান যুদ্ধে। মোটাদাগে অভিবাসন নীতি, সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, তুরস্কের সাথে শরণার্থী চুক্তিসহ রাশিয়ায় উপর অবরোধকে কেন্দ্র করে ইউরোপিয়ানদের দ্বিধাবিভক্তি প্রকাশ পেয়েছে। এই দ্বিধাবিভক্তিতা ইউরোপের উগ্র চরমপন্থি রাজনীতিকে তরান্বিত করে মূলধারায় জায়গা দিয়েছে। জার্মানি, ইতালি, স্পেন, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড তার বড় নমুনা। অভ্যন্তরীণ এই বিভাজন নিয়ে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইউরোপের স্থান কি হবে, আদৌ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন টিকে থাকবে কিনা, ব্রিটেনের মত করে ইতালি এবং ফ্রান্সও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকার বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই করোনা মহামারী পরবর্তী দুনিয়ার রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের সূত্র বিদ্যমান বলেই ধারনা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তাই করোনা পরবর্তী আগামী এক দশকের ইউরোপের রাজনীতিতে অন্ততপক্ষে ৩ টি পরিবর্তন এড়ানো অসম্ভব হতে পারে।
প্রথমত, রাশিয়া সম্পর্কিত ইউরোপের নীতিতে পরিবর্তন। মোটাদাগে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন একে ওপরের পরিপূরক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেখানে রাজনৈতিক কাঠামো ন্যাটো সেখানে প্রতিরক্ষা কাঠামো। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আদর্শিক যুদ্ধ এই দুটি কাঠামোকে মজবুত করেছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানের দরুণ সাম্প্রতিক রাশিয়া আবার ইউরোপের রাজনীতিতে দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক দিক থেকে রাশিয়া এখন ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম অংশীদার। ডলারের হিসেবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। একই সাথে প্রতি বছর রাশিয়া তিনশো বিলিয়ন কিউবিক গ্যাস রপ্তানি করে ইউরোপে। জ্বালানি নির্ভরতা ইউরোপ ও রাশিয়াকে নিকটস্থ করেছে। রাজনৈতিকভাবে রাশিয়া এখন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার নীতিনির্ধারণী শক্তি। তাই করোনাভাইরাসে প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সময়ে মার্কিনীদের দুর্বল নেতৃত্ব রাশিয়া-ইউরোপের সম্পর্ক জোরদার করলে বিশ্বের রাজনৈতিক কাঠামোর বর্তমান অবস্থা ফিকে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভাঙ্গনের সুর। করোনাভাইরাসের মত আন্তর্জাতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যর্থতার দরুন ব্রেক্সিটের মতই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। সরকারের উপর অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে বিশেষ করে স্পেন, ইতালি নেদারল্যান্ড এবং ফ্রান্সে। যার পেছনে থাকবে উগ্র ডানপন্থীদের উস্কানি। ইউরোপের উগ্র ডানপন্থীদের অঘোষিত নেতৃত্বে রয়েছে যথাক্রমে ইতালির মাত্তিও সালভিনি ও ফ্রান্সের মারিনা লে পেন। উভয়েরই পুতিন সখ্যতার কথা সুপরিচিত। তাই আগামী দিনে সালভিনি ও লে পেন ব্রেক্সিটের মত করেই গণভোটের জন্য প্রচারণায় নামলে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। সম্ভবত এই পরিস্থিতি আচ করতে পেরে করোনা পরবর্তী সময়ে “করোনা জাতীয়তাবাদ” থেকে মুক্ত থাকার কথা বলেছেন ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন।
তৃতীয়ত, মার্কিন-ইউরোপের সম্পর্কে কাঠামোগত পরিবর্তন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিনীদের যুদ্ধযাত্রাসহ সকল নীতিতে ইউরোপের নীরব সমর্থন ছিল। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র মিলে শাসন করেছিল দুনিয়াকে। কিন্তু ট্রাম্পের “সবার আগে আমেরিকা” নীতি ইউরোপকে আকস্মিকভাবে নি:সঙ্গ করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। আলোচনা ব্যতীত সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার, জলবায়ু ও ইরান চুক্তি থেকে সরে যাওয়াসহ সর্বশেষ ইউরোপের সাথে বিমান চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা ইউরোপিয়ানদের ক্ষুদ্ধ করেছে। এই হতাশা থেকেই ইউরোপের নিজস্ব নীতি গঠনের কথা উঠে এসেছে। যার প্রমাণ মিলেছে ফরাসি রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রনের ইউরোপের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যূহ গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও জার্মানির অর্থমন্ত্রীর মার্কিন ফেডারেল ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে বিকল্প অর্থ আদান-প্রদান প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে। স্পষ্টভাবে করোনা মহামারী মোকাবিলায় মার্কিনীরা যে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন তা করোনা পরবর্তী সময়ে মার্কিনীদের উপর থেকে ইউরোপের ভরসা হ্রাস করে নিজস্ব নীতি প্রতিষ্ঠা করতে ইউরোপিয়ানদের উৎসাহিত করবে।
করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিভাবে অর্থনৈতিক চঞ্চলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে তার সুস্পষ্ট নীতি এখনো ঘোষিত হয়েনি। সামগ্রিকভাবে ঘোষিত হয়নি আক্রান্ত দেশসমূহের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ। অর্থনীতির এই অনিশ্চয়তা রাজনীতিতে দুঃসময় নিয়ে আসতে পারে, ক্ষমতায় আসতে পারে উগ্র ডানপন্থীরা। উগ্রবাদীদের ক্ষমতা গ্রহণ ইউরোপের মৌলিক রাজনীতির শর্তসমূহকে আঘাত করতে পারে। চালু হতে পারে নানা বিধিনিষেধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহের উপর আঘাত আসতে পারে, জেঁকে বসতে পারে কর্তৃত্ববাদ। হাঙ্গেরি ও ইসরাইল ইতিমধ্যেই যার প্রমাণ দিয়েছে করোনা সম্পর্কিত খবর প্রকাশে স্বাধীনতা খর্ব করে ও নির্বাচনে হেরেও জরুরী অবস্থার নামে করে নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা। ইউরোপের যে কোন নীতি পরিবর্তন মার্কিন বিরোধীদের রাস্তা সুগম করবে। তৈরি করবে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো।
রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন