যে কোটা আন্দোলনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র অকৃতজ্ঞ ছাত্রদের নখড়ামি বলে ঠাহর করছেন, তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই বোঝা যায় যে এটি তেলা মাথায় ভর্তুকি পাওয়া স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রথম দাবি নয়, বরং কাঠামোগতভাবে বঞ্চিত নিম্ন মধ্যবিত্ত নাগরিকদের প্রাণের দাবি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদের বক্তৃতা নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে কেননা তার ব্যক্তিগত জীবনে এমআইটির টিউশন ফি-এর প্রকোপ নিয়ে বলা ঘটনাটি অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তবে সেই বক্তৃতা নিয়ে চটুল হাসিতামাশা করাকে আমাদের যতই আনন্দজনক মনে হোক না কেন, তার বক্তৃতার বাকি অংশটিতে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ সত্য তুলে ধরেছেন, সেটার দিকেও আমাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেছেন উন্নত অনেক দেশের ‘টিউশন ফি’ এর তুলনায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টিউশন ফি’ নেই বললেই চলে এবং অভিযোগ করেছেন যে সেই বিনামূল্যে শিক্ষা পাবার পরেও ছাত্ররা অকৃতজ্ঞের মতন আন্দোলন করতে যায়। হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য ছিলো কোটা সংস্কারের আন্দোলন নিয়ে একটি মতামত ব্যক্ত করা, তবে সেটা করতে গিয়ে তিনি এই কোটার আন্দোলনের গোড়ার বৈষ্যমের দিকেও একটি আঙ্গুল তুলেছেন যেটিকে আমনে নিলে তার সরকার আরও বেশি গণমুখী বন্টনের দিকে আগাতে পারে। সেই বৈষম্য হলো সবার জন্যে সমান বেতনের সমতার বৈষম্য।
সমতার বৈষম্য ব্যাপারটা আরেকটু সহজে বোঝানোর জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতন নাহয় আমিও একটি ছোট গল্প বলি। গল্পের খাতিরে বরং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলেছেন, সেই এমআইটি নিয়েই বলি। এটা ঠিক যে এমআইটি সহ আমেরিকার অনেক প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়েই বেশ চড়াদরে টিউশন ফি দিতে হয়-তবে সেটা যে সবারই সমান পরিমাণে দিতে হয় এমন নয়। আমেরিকার ফেডারেল সরকারের ফাফসা বা ফেডারেল স্টুডেন্ট এইডের ফ্রী অ্যাপ্লিকেশনে ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের ও তাদের পিতামাতার সম্পদ এবং আয়-ব্যয়ের হিসেব জমা দেয় এবং তার ভিত্তিতে সরকার এবং অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে দেয়। এমআইটি যেহেতু নিড ব্লাইন্ড একটি বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু তারা সম্পদের হিসেব করে যদি দেখতো যে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেবার মতন সম্পদ ছাত্রের কাছে নেই, তাহলে তারাই অর্থের যোগানের ব্যবস্থা করে দিতো, তা লোন দিয়েই হোক আর স্কলারশীপ দিয়েই হোক। কাজেই যদি হঠাৎ করে কোন শিক্ষার্থীর পরিবারের সম্পদ আয়ব্যয়ে বিশাল কোন পরিবর্তন না আসে, তবে তার টিউশন ফিয়ের যোগান দিতে খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়, এবং হলেও তার দায়িত্ব নিতে অনেক সময় প্রস্তুত থাকে বিশ্ববিদ্যালয়।
অথচ বাংলাদেশের সরকারী ভর্তুকির ব্যাপারটি ঠিক এর উলটো। কেবল আয়ব্যয়ের হিসেব দেখে যে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছলদের জন্যে বেশি সুবিধা রাখা হয় না তা নয়, একইসাথে আর্থকভাবে স্বচ্ছল অঞ্চলগুলোর পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় বেশি করেও বিনিয়োগ করা হয়। মেট্রোপলিটানের সরকারী স্কুলে যখন আমরা এস্কেলেটর বসানোর খবর শুনি, ঠিক সেই সময়েই শুনি যে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে খোলা আকাশের নিচে একজন ধূসর মাস্টার ক্লাস নিচ্ছেন অথবা এমপিওর দাবিতে অনশন করছেন হাজার হাজার শিক্ষিকা। কাজেই আমাদের শিক্ষার ভর্তুকি কেবল যে প্রগতিশীল (progressive) হতে ব্যর্থ, তা-ই নয় বরং একই সাথে অনেকখানিই প্রত্যাবর্তী (regressive)। এই অসম বন্টনের কারণে গ্রামে ও শহরে একেবারে স্কুল পর্যায়ে তৈরি হচ্ছে ভাগ্যোন্নয়নের সুযোগের অসমতা। সেই অসমতা পরবর্তীতে এসে গড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে, কেননা ভর্তি কোচিং ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাগুলো অসচ্ছল সন্তানেরা পাচ্ছে কম, এবং সেই অসমতা গিয়ে শেষপর্যন্ত মিশছে কোটাবৈষম্যের মোহনায়। যে কোটা আন্দোলনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র অকৃতজ্ঞ ছাত্রদের নখড়ামি বলে ঠাহর করছেন, তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই বোঝা যায় যে এটি তেলা মাথায় ভর্তুকি পাওয়া স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রথম দাবি নয়, বরং কাঠামোগতভাবে বঞ্চিত নিম্ন মধ্যবিত্ত নাগরিকদের প্রাণের দাবি। কাজেই যখনই প্রধানমন্ত্রী একইসাথে কোটার আন্দোলন এবং শিক্ষার বণ্টন নিয়ে কথা বলেন-তখন অবশ্যই তাকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে কোটার আন্দোলন তৈরি হয়েছে গণশিক্ষাখাতের ব্যয়ে বৈষম্যমূলক অথবা নিদেনপক্ষে অলস বন্টন ব্যবস্থার কারণে।
অথচ যদি আমাদের দেশে শিক্ষাখাতে ভর্তুকি দেবার ব্যপারটি এতোটা অলস না হয়ে একটু প্রগতিশীল হতো, তাহলে সবার জন্যে একটি ফ্ল্যাট রেটে বেতন না রেখে বরং অসচ্ছলদের জন্যে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগটিকে আরো প্রসারিত করা যেতো। মধ্যবিত্ত ও ধনী পরিবারের যেসকল সন্তানেরা তাদের শিক্ষার পেছনে কিছুটা অর্থ ব্যয় করবার সামর্থ রাখে, তাদের পেছনে তিন তিনটি সরকারী বৃত্তির অর্থ ব্যয় করাটা অর্থের অপচয় না করে তাদের বৃত্তির সম্মানটি কেবলমাত্র একটি সনদ দিয়ে জানানো যেতো আর বেচে যাওয়া অর্থটি তখন কাজে লাগানো যাবে কোন অসচ্ছল মেধাবী ছাত্রীর জন্যে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনের ক্ষেত্রেও যদি ধনী পরিবারের সন্তান সন্ততিদের বাড়তি ভর্তুকি না দিয়ে সেই অর্থকে গবেষণা আর দরিদ্র সন্তানদের জন্যে আলাদা করে বরাদ্দ করে রাখা যেতো, তাহলে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে যেতে পারতো আরো অনেকের কাছে।
কাজেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার ব্যয় নিয়ে সংসদে যে বিষয়টি তুলে এনেছেন সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে শিক্ষার বরাদ্দ নিয়ে একটি আলোচনার অংশ করে তুলতে না পারলে আবার নানান সমস্যার ভীড়ে এই ভয়ংকর কাঠামোগত ত্রুটিটি হারিয়ে যাবে। আমরা বারবার শুনি যে আমাদের দেশে শিক্ষার জন্যে যথেষ্ট হারে বরাদ্দ দেয়া হয়না এবং নানা উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় আমাদের বরাদ্দ জিডিপির শতাংশের অনেক কম। সেটি খুবই সত্য একটি সমালোচনা এবং সেইদিক থেকে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু একই সাথে বরাদ্দকৃত অর্থ কেমন করে খরচ হবে, সেটিরও যদি সংস্কার না হয় তাহলে আমাদের গণশিক্ষাকে গণমুখী করতে আমরা ব্যর্থই রয়ে যাবো। কোটা সংস্কারের আন্দোলন আমাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি ভাগ্যোন্নয়নের সুযোগের যে বৈষম্যকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের কাছে তুলে ধরেছে সেটির সংস্কার করতে গেলে কেবল একদানে কোটা বাতিল করে দিলেই হবে না, একইসাথে গণশিক্ষার খাতে প্রতিটি পর্যায়ে প্রগতিশীল বন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্যে অধিকতর সুযোগের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা না করে কেবল কোটা আন্দোলনকারীদের উপর অভিমান করে বসে থাকলে আমরা আজ যে তিমিরে রয়েছি, সেই তিমিরেই রয়ে যাবো।
লেখক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আর অর্থনীতির ছাত্র এবং বিকল্প গণমাধ্যম মুক্তিফোরাম এর সম্পাদক।
মতামত দিন