আমরা ১ হাজার টাকা বিল হলেও দেই
আমি গুলশান চিনি না ঠিক মতো। এক নম্বর, দুই নম্বরে তালগোল পাকাই। কাগজে ঠিকানা লিখে দিলে আসতে পারি। ফেরার সময় ভেজাল লাগে।
৬ নম্বর বাসে আসি। কাওরানবাজার থেকে পনের টাকা ভাড়া।
কাওরানবাজার আমার অফিস। পত্রিকা অফিস। মহল্লার অনেকে আমাকে ভাবে সাংবাদিক। বউকে সত্য বলেছি শুধু। আসলে আমি পত্রিকা অফিসের পিয়ন। বেতন ৬ হাজার ৭০০ টাকা। অনেক ডিউটি আমার। স্যারদের রুম পরিষ্কার করি। পানি বোতলে ভরে দেই। পত্রিকার ফাইল বানাই। চা নিয়ে যাই রুমে রুমে। অফিসের বাইরেও ডিউটি থাকে। ঐ যে গুলশান। ঐ এলাকায় এজন্য যেতে হয়। লেখক স্যারদের বাসায় টাকা, চেক দিতে যাই। বড় বড় স্যার তারা। বড় বড় বিয়ষ নিয়ে যারা লেখেন আর কী! বাসা ভর্তি বইওয়ালা লোক। ব্যবহারও ভালো তাদের। আমাকে চা খাওয়ায় অনেকেই। নাম ভুলে গেছি এক স্যারের। তার বাসা আবার ধানমন্ডি। সে আমার ছেলের জন্য একবার কমলা দিয়েছিল।
এত কথা বলার কারণ একটাই। পিয়ন হলেও আমি ইজ্জত পাই। আমাদের পত্রিকার সম্পাদক সাহেবও আমাকে আদর করেন। সেদিন লিফটে দেখা হয়েছিল। বললেন, “শহীদ, তোমার বাইক নাই?” আমার পুরো নাম শহীদুজ্জামান। মানুষ ডাকে শহীদ ডাকে। আমি বললাম, “না, স্যার।” চালাতে পারি না। স্যার বললেন, “শিখে ফেল। অফিসে তো মোটর সাইকেল আছে।” স্যার যে আমাকে বাইক দিতে চেয়েছেন এজন্য না। স্যার আমাকে ইজ্জত দেন। এই ইজ্জত পাওয়াই সব। ইজ্জত দামি জিনিস। সবাই পায় না।
আমার বউ এটা বোঝে না। আমি চাকরি করি এটা সে চায় না। আমার শ্বশুরকূলের আত্মীয়রা বড়লোক। বিয়ের সময় আমি কিছু জমি পাই। সঙ্গে কিছু নগদ টাকা। নূরীর ইচ্ছা আমি সে টাকায় ব্যবসা করি। নূরী আমার বউয়ের নাম। ডিগ্রি পাস মেয়ে। ভালো নাম নূরজাহান বেগম। ওর বাপের বাড়ির লোকজন ডাকে “জাহান” নামে। আমি ডাকি “নূরী” নামে।
নূরী চায় আমি যেন মুন্সিগঞ্জ ফিরি। মুন্সিগঞ্জ আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকা। সেখানে যেন ছোটখাটো একটা দোকান দেই- এটা বউয়ের ইচ্ছা। আমি ওরে বোঝাতে পারিনা। এ নিয়ে আমাদের প্রায়ই লাগে। রেগে গেলে নূরী আমাকে আপনি ডেকে ফেলে। বলে, “আপনার দরকার কি পিয়নের চাকরি করার? চলেন আমরা মুন্সিগঞ্জ যাই। ছোটখাট একটা দোকান ভাড়া দেই। পত্রিকা অফিসের চাকরির কোনো ভবিষ্যত নাই।”
নূরী ইজ্জত বোঝে না। কোথায় সাংবাদিকের জীবন আর কোথায় দোকানদার! ও রেগে গেলে আমি চুপ থাকি। এমন তো না আমাদের খুব অভাব। চলে যাচ্ছে তো দিন। আমার ছেলের নাম শরীফ। পুরো নাম শরীফুজ্জামান। ঠিক করা ছিল মেয়ে হলে নাম হবে জান্নাত নূরী। বউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। কিন্তু ছেলে হওয়ায় আমার সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছি। শরীফের বয়স এখন ৩। আগামী বছর তারে স্কুলে ভর্তি করাবো। শরীফ এ, বি, সি, ডি পড়তে জানে। এক থেকে বিশ গুনতে জানে। ছড়া শিখিয়েছি চার, পাঁচটা। আলহামদু সুরাও মুখস্ত।
আমাদের বাসা তেজকুনীপাড়া। অফিস যাই রিকশায়। কখনও হেঁটে। কাওরানবাজারের সবচেয়ে উচু বিল্ডিংটায় আমার অফিস। লিফটের ১৭। এ বিল্ডিংয়ের ছাদে নামাজের ব্যবস্থা আছে। ছাদ থেকে রায়েরবাজারের দিকের তুরাগ নদী দেখা যায়। নিচের রাস্তায় গোলমাল বা এক্সিডেন্ট হলে অফিসের ক্যামেরাম্যানরা ছাদে ওঠে। ছাদ থেকে নিচের ছবি তোলে।
ক্যামেরাম্যানদের মধ্যে আমাকে বেশি পছন্দ করে সুভাষ’দা। পাগল পাগল ভাবের একটা মানুষ। আমাকে দেখলেই শুধু বলেন, “শহীদ, কেমন কাটছে ঈদ?” আমি হাসি। অফিসে আমাকে একমাত্র তুই বলে সুভাষ’দাই।
একবার নূরী, শরীফকে নিয়ে অফিসে এসেছিল। সুভাষ’দা তখন আমাদের ছবি তুলে দেন। আমি ৮০০ টাকা দিয়ে সে ছবি বাধিয়েছি। আমাদের ঘরে এখন সে ছবি। নূরী বলে ঘরে ছবি থাকলে ফেরেশতা আসে না। তুমি ছবি সরাও। আমি রাজি হই না। শরীফ যখন ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, আমার বাবা। তখন খুব ভালো লাগে।
পত্রিকা অফিসের চাকরিতে ছুটি কম। মহরম, মে দিবস আর দুই ঈদে তিন দিন করে। ঈদের তিন দিন শ্বশুরবাড়িতে চলে যাই। আমার কোনো আত্মীয় ঢাকায় থাকে না। আমরা মুন্সিগঞ্জ যাই লঞ্চে। দোতলা লঞ্চ। সদরঘাট থেকে ছাড়ে। এক ঘন্টার পথ। নূরী চানাচুর খেতে পছন্দ করে লঞ্চের। অনেক ফেরিওয়ালা থাকে লঞ্চে। গতবার এক জাদুকরকেও পেয়েছিলাম। সে কাগজ কেঁটে জোড়া দেওয়ার ম্যাজিক দেখায়। শরীফ খুব খুশি হয়েছিল দেখে। আমি জাদুকরকে পঞ্চাশ টাকা দেই। সে খুব খুশি হয়। জিজ্ঞেস করি, নাম কী? সে বলে, ফরিদ, রাজবাড়ি, মাটিপাড়া। এরপর হলুদ দাত বের করে হেসে বলে, পুরা অ্যাড্রেস দিয়া দিলাম। আইসেন।
বললাম, আচ্ছা আসবো।
কিন্তু আমার কি কখনও যাওয়া হবে মাটিপাড়া? এই লোক কি ঘরেও জাদু দেখায়? তার বাচ্চা আছে? কী মজা! এগুলো ভাবলাম। মুখে বললাম না কিছুই।
মুন্সিগঞ্জ আমার বউ, ছেলের খুব পছন্দ। শ্বশুর বাড়ি শহরের বাইরে। খুব নিরিবিলি জায়গা। গাছপালা অনেক। আমি না হয় সারাদিন অফিসে থাকি। নূরী তো সারাদিন তেজকুনীপাড়ার ঘরেই থাকে। এজন্যই ও বাপের বাড়ির জন্য তড়পায়। আমাকে ব্যবসা করতে বলে সেখানে। কিন্তু আমি পত্রিকা অফিসের চাকরি ছাড়তে রাজি না। সেদিন মহল্লার চায়ের দোকানের মেহেদী ডাক দিলো, “সাংবাদিক সাব চা খাইয়্যা যান” কাছে গেলে জিজ্ঞেস করে, “ভাই, টেরাম্প হালা কী যুদ্ধ লাগাইয়াই দিবো নাকি? কন আপনি তো সাংবাদিক মানুষ।”
এই যে ইজ্জত সেটা কি মুন্সিগঞ্জের জীবনে আছে?
সে দিন ঠিকানা নিয়ে গেলাম আবার গেলাম গুলশান। নতুন এক স্যারের বাসায়। অফিসের টাকা দিতে। বিরাট বিল্ডিং। মনেহয় ১০ কাঠা জায়গা হবে। সামনে ঝর্ণা। পানি আসে কোত্থেকে, যায় কৈ- কে জানে! না জানি বাড়ির ভিতরটা কেমন!
স্যার বাসায় নাই। নিচে গার্ড জানালো। গাড়ি নিয়ে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। আমি খাম বের করে তার হাতে দিলাম। গার্ড জিজ্ঞেস করে, কী?
: টাকা।
: কত টাকা?
: ৬ হাজার।
গার্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার প্রশ্ন
: কোন জায়গা থেকে আসছেন?
: দৈনিক আলোচ্য।
আবার প্রশ্ন গার্ডের।
: মাত্র ৬ হাজার টাকা?
লোকটাকে বেকুব না কী! কথা বাড়াই না। আমার পত্রিকার ইজ্জত জানে? বললাম,
: ভাই, আপনি এইটা বুঝবেন না। আমরা ১ হাজার টাকা বিল হলেও দেই।
আবার প্রশ্ন গার্ডের।
: ১ হাজার টাকাও নেন স্যাররা?
আবার বিরক্ত লাগে। দৈনিক আলোচ্যকে চেনে এই বেকুব? মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। বাসায় যেতে হবে। কথা বাড়াই না। বললাম,
: ভাই, খামটা রাখেন। স্যারকে পৌঁছে দিয়েন।
বের হলাম। দেখি বাইরের ঝর্ণায় নীল লাইট। ভিতর থেকে ঝিঝিমিকি নীল আলো বের হচ্ছে। খুব সুন্দর। ঈদে এবার বোনাস হলে ক্যামেরা ফোন কেনার ইচ্ছা আছে। শরীফও খুশি হবে।
কিন্তু এখন যাবো কোন দিকে? আবার গুলশান ১, ২ নিয়ে তালগোল। দেখি জিজ্ঞেস করি কাউকে। সামনে হাঁটি।
হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকার মিরপুরে। পড়েছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ২০০৫ সাল থেকে। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।
২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।
মতামত দিন