পদার্থবিদ রিচার্ড ডিক ফাইনম্যান বলেছেন, প্রকৃতির কার্যকরণ বুঝতে পারাই বিজ্ঞান
বই: আরো রম্য আরো বিজ্ঞান
লেখক : আহসান হাবীব
প্রকাশক : অনুপম প্রকাশনী
সময় প্রযুক্তিময়। নিদানকালে বন্দি মানুষের অপরিহার্য এক অঙ্গ যেন মুঠোফোন। তৃতীয় বিশ্বের গ্রাম পর্যায়েও ডিজিটাল প্রযুক্তি। সভ্যতা এগোচ্ছে সন্দেহ নেই। যখন এই অগ্রগতির কথা তখন প্রশ্ন এসে যায়, কত দূর এগোলো মানুষ? এ নেহাত কাব্যিক জিজ্ঞাসা না। অনন্ত সম্ভাবনার মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে কথা। পৃথিবীতে যুদ্ধ থামেনি। দিকে দিকে ধর্ম বিশ্বাস বা মানুষের একান্ত অনুভূতি নিয়ে রক্তাক্ত জনপদ। শিশু ও নারীদের ওপর জুলুম বাড়ন্ত। ক্ষুধায় মৃত্যু অগণন। অন্যদিকে মহামারীতেও সম্পদ উপচে পড়ছে সিলিকন ভ্যালির টেক জায়ান্টদের।
এ পরিস্থিতিতে তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তফাত টানাই কর্তব্য। করোনাভাইরাস মহামারিতে আয়োজিত এ বছরের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত ‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’ বইয়ে এ কাজটি করেছেন লেখক আহসান হাবীব।
লেখক বলাবাহুল্য হুমায়ূন আহমেদ অনুজ। জিনগতভাবে যে পরিবারটি সহজ শিল্পচর্চায় নন্দিত। চারদশকের বেশি সময় ধরে দেশের একমাত্র স্যাটায়ার ম্যাগাজিন ‘‘উন্মাদ’’ এর সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট হিসেবে জনপদে আহসান হাবীবের খ্যাতি। তবে এ পরিচয় আড়াল করে তার মানবনিষ্ঠ ও সময়োপযোগী আরও গুরুত্ববাহী সৃষ্টি। ‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’ সে আড়ালের উন্মোচন।
লেখক ভূমিকায় জানান, দেশের ৩টি বিজ্ঞান পত্রিকা (বিজ্ঞান সাময়িকী, বিজ্ঞান চিন্তা ও মহাবৃত্ত) তিনটির সাথেই তিনি যুক্ত ছিলেন বা আছেন। আর এই তিন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাসমূহের সঙ্গে নতুন সংযোজনেই আলোচ্য ‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’। অনুপম প্রকাশনী প্রকাশিত এ বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে ৫৩টি স্বতন্ত্র লেখা। আদতে অমূল্য ১৩৬ পৃষ্ঠার এ বইয়ের গায়ে লেখা দাম ২৪০ টাকা। এর প্রচ্ছদকার জনপ্রিয়তম ধ্রুব এষ।
পদার্থবিদ রিচার্ড ডিক ফাইনম্যান বলেছেন, প্রকৃতির কার্যকরণ বুঝতে পারাই বিজ্ঞান। সহজ এ কথাটি ইদানিং বোধগম্য নয়। আরও না বোঝা কথা হলো, বিজ্ঞানের বাইপ্রোডাক্ট হচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি নিয়ে সবখানে মাতিমাতি। অথচ নেই সহজ ভাষায় বিজ্ঞান ব্যাখ্যার সর্বস্তরে বিস্তৃত আয়োজন। জটিল সমীকরণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সেমিনারে আলোড়িত হয় না সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ। স্যাটেলাইট ও ডিজিটালে গর্বিত দেশ সয়লাব কুসংস্কারে। মানুষ, প্রকৃতিবিদ্যা ও সমসময় বিরুদ্ধ ওয়াজ ইউটিউব মাফিক ‘‘মোস্ট ভিউড’’ কনটেন্ট। ভেদহীন মানুষের সমাজ তৈরিতে বারবার রাশ টেনে তা যেন হুমকি দেয় পারলে ঠ্যাকা ভঙ্গিতে। আর সেই পেছনে টানা অপশক্তির সঙ্গে আঁতাত দলনির্বিশেষে সকল রাজনীতির। এ পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক কাজ বিজ্ঞানের সহজ বিস্তৃতি। লেখক সহজ কাজকে সহজতর করেছেন রম্যের কুশলতায়। যেকোনো পাঠক হাসতে হাসতে ঋদ্ধ হবেন ‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’ এর পাতায় পাতায়। বিজ্ঞানের আরও গভীরে প্রকাশে এরপর পাঠক খুঁজে নেবেন তাঁর পথ।
‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’ এক বিরতিহীন পাঠযোগ্য বই। রম্য যেখানে চাবুকের মতো ঘাঁ মেরে শেখায়। বহু কৌতুহল পূরণের পরও বিজ্ঞানের স্বভাবসিদ্ধ রহস্যময়তা এ বইয়ের পাতায় পাতায়। এক মলাটে পাঠক পাবেন ইতিহাস, এই সময় আর ভবিষ্যত নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ফ্যান্টাসি। শাসন, শোষণের সঙ্গে চলমান ইঁদুর বিড়াল খেলাও ইঙ্গিতপূর্ণ এ বইয়ে।
নাম না শোনা অনেক বিজ্ঞানী কৃর্তিময় জীবন সম্পর্কে জানা যাবে আলোচ্য বইয়ে। ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন, অ্যাকুয়া থার্মাল কন্ডিশন, জিনম সিকোয়েন্স, সাইকোকাইনেসি’র মতো কঠিন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সরলিত এ বইয়ে।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, তুমি যদি ছয় বছরের একটি শিশুকে কোনো কিছু বোঝাতে না পারো, তাহলে বুঝবে- তুমি বিষয়টি বোঝনি। লেখক আহসান হাবীব অবশ্য জনগণকে মহৎ কিছু ছবক দেয়ার পণ নিয়ে ‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’ বইটি লিখেননি। বরং ভূমিকায় স্বভাবস্বিদ্ধ জোক লিখেছেন।
‘‘- আচ্ছা আপনার বইয়ের প্রথম পাঠক কে?
- কেন প্রুফ রিডার
- আর শেষ পাঠক?
- ঠোঙ্গাওয়ালা।’’
এর উত্তরে হাসি অনিবার্য। একে আবার অন্যভাবেও শনাক্ত করা যায়। গণমুখী সৃষ্টিময় অক্ষরমালা প্রথমে প্রুফ রিডারের হাতেই পৌঁছে। পরে তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে পঠিত হয়ে লিফলেটে রূপ নিয়ে নিম্নবর্গের মুক্তিদাতা হয়ে ওঠে।
শেষ কথা বলা যায়, ‘‘আরো রম্য আরো বিজ্ঞান’’ এমন এক বই, যার বহুল বিস্তৃতি পথচ্যুত বাংলাভাষী জনপদকে সুরক্ষিত রাখবে।
মতামত দিন