এত প্রচারণা আর জনপ্রিয়তার পরেও কীভাবে মমতা ব্যানার্জির কাছে বিজেপি হেরে গেলো তার সাতটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের তীব্র লড়াইয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নিজেদের সমস্ত সম্পদ, বিপুল পরিমাণ অর্থ, জাতীয় নেতাদের নির্বাচনে নিয়ে আসা, নির্বাচনের আয়োজনকে প্রভাবিত করা কিংবা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা কোনোটাই বাকি রাখেনি।
এতকিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত, কোনোটাই আর কাজে আসেনি বিজেপির। ৪৮% ভোট আর ৭৩% আসন নিয়ে বিজয়ী তৃণমূল কংগ্রেসের এ যাবৎকালের সেরা জয়ের কাছে বিজেপি বেশ বাজেভাবেই হেরেছে। এত প্রচারণা আর জনপ্রিয়তার পরেও কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিজেপি হেরে গেল তার সাতটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
যেকোনো সমস্যায় নগদ অর্থ প্রদান
তৃণমূলের ভোট পাওয়ার পিছনে একক বৃহত্তম কারণ এটি। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল রাজ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এনেছে। এর মধ্যে-- মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে স্কুলে পাঠালে নিয়মিত নগদ প্রদান, যুব নাগরিকদের বেকারত্বের দোল, দলিত ও সংখ্যালঘুদের জন্য বৃত্তি, কৃষকদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যয় প্রদান (মৃত্যুর ক্ষতিপূরণসহ), বার্ধক্য এবং বিধবাদের পেনশনের ব্যবস্থাসহ আরও অনেক কিছু। অর্থাৎ যে কোনো সমস্যার সমাধানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নগদ অর্থ প্রদান করতে প্রস্তুত।
তৃণমূলের কল্যাণমূলক নেটওয়ার্কটি এতটাই বিশাল যে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মৈত্রিশ ঘটক সংবাদমাধ্যম স্ক্রোল ইনকে বলেছেন, এই নগদ অর্থ স্থানান্তর ফান্ড রাষ্ট্রের পল্লী মাথাপিছু ব্যয় বৃদ্ধির হার এবং দারিদ্র্য নিরসনের অতীতের তুলনায় এগিয়ে নিয়েছে জাতীয় গড়কে।
তৃণমূল কংগ্রেসের "কাটা টাকা" বা ঘুষ, জাত ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগও এসেছে। তবে অভিযোগ থাকলেও সাধারণ মানুষ নগদ অর্থের বিষয়ে বরাবরই খুশি।
তৃণমূলের শক্তিশালী পার্টি সংস্থা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য যেমন বাংলাকে "পার্টি-সমাজ" দ্বারা বর্ণিত করেছেন তেমনি বাংলা আসলে একটি ব্যবস্থা যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণের অধিকার ও ক্ষমতাকে পুরোপুরি দখল করে নেয় এবং সামাজিক সংগঠনের পুরানো ফর্ম'র (যেমন- বর্ণ বা ভূমি মালিকানা) পিছনে স্থান নেয়।
অবিশ্বাস্যভাবে বাংলায়, শক্তিশালী সংগঠনের সাথে দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে। এর ভিত্তিতে, তৃণমূলের সাথে বিজেপি'র কোনো মিল ছিল না। মমতার দল নিজেদের হাতিয়ার ব্যবহার করে শুধুমাত্র নিজস্ব ভোটই অক্ষুণ্ণ রাখেনি। বরং এটাও নিশ্চিত করেছিল ভোটারদের অন্য একটি অংশ অপর দলের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উল্টো তাদেরই যেন ভোট দেয়। এটা বাঙালি রাজনীতির এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য।
যদিও এই বিষয়টি গণমাধ্যমে যেন প্রকাশ করা হয় সেটি বিজেপি নিশ্চিত করেছিল তবে বিজেপির র্যালি কিংবা সভাগুলো প্রায়শই জনশূন্য থাকতো। এমনকি কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনসভা ময়দানও অর্ধেক ফাঁকা ছিল। বিজেপির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তখন তাদের আগের সমাবেশের ছবি টুইট করতে বাধ্য করেছিল আর এর ফলে বিজেপি নিজেই নিজেদের প্রতিচ্ছবি খারাপ করেছিল।
বিজেপি যখন তৃণমূল নেতাদের দমানোর জন্য নগদ অর্থ এবং কখনও কখনও আইনি হুমকি ব্যবহার করে জয়ী হবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল তখনই তাদের অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করে।
মুসলিমদের ভোট
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যার গড় জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। মুসলিম ভোট সর্বদা তৃণমূলের পক্ষে একটি বিশাল সুবিধা হয়ে ছিল। একইভাবে এটি বিজেপির জন্য একটি বিশাল অসুবিধা ছিল।
আর এই অসুবিধার কথা চিন্তা না করেই বিজেপি সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিজেপির অতীত কর্মকাণ্ডও প্রভাব ফেলেছিল। সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব পরীক্ষা বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেনের প্রতিশ্রুতি বিজেপির উপর বাংলার মুসলমানরা ভীত করে তুলেছিল। এমনকি বাংলার কেবলমাত্র দু'টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাতেও মুসলমানরা প্রথমবারের মতো তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে প্রত্যাশিতভাবে, সব ভোট তৃণমূলের ঘরে গেছে।
নারী ভোট
তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে মুসলমানদের সমর্থন গণমাধ্যমে অনেক বেশি মনোযোগ পেলেও মূলত দলটির বৃহত্তম "ভোট ব্যাংক" কোনো সম্প্রদায় নয় বরং লিঙ্গ।
২০১৯ সালে, সেন্টার ফর ডেভেলপিং সোসাইটিসের লোকনীতির জরিপ অনুসারে, তৃণমূল কংগ্রেসই একমাত্র দল যাদের পুরুষদের চেয়ে নারী ভোটার বেশি ছিল। অর্থাৎ বাংলার ৪৭% নারী তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। অন্যদিকে বিজেপিকে দিয়েছে ৩৮% নারী।
মুসলমানরা যদি জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ হয়, তবে নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক। নারী ভোট তাই তৃণমূলের জন্য একটি বিশাল লভ্যাংশ।।
অবিশ্বাস্যভাবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি নারীদের হাতে নগদ অর্থ স্থানান্তর করার জন্য পরিকল্পনামাফিক নারীদের উজ্জীবিত করার দিকে তীব্র মনোনিবেশ করেছেন। আর এর পরিবর্তে, স্পষ্টতই সেই হাতগুলো ইভিএম মেশিনে তৃণমূলকে বেছে নিয়েছে।
মমতার ইমেজ ও রাজ্য নির্বাচন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের এযাবৎকালের সর্বোচ্চ নেতা তাতে সন্দেহ নেই। নির্বাচনের ঠিক আগে করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ৫৭% ভোট পেয়েছেন। যা ২০১৯ সালেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিমান হামলার ঘটনায় জাতীয় নির্বাচনের সময় বিজেপির পাওয়া ৪১% তুলনায় অনেক বেশি। স্পষ্টতই বিজেপির এই হার একসময় আর উপরে না উঠে নিচেই নামবে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ
সাম্প্রতিককালে তৃণমূলের মধ্যে কোনও আদর্শিক মূলমন্ত্র ছিল না। তবে, ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী আদর্শিক মূলধারার দিল বিজেপির মুখোমুখি হয়ে দলটি নিজেকে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল।
বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদ মোকাবেলায়, বাংলাভিত্তিক তৃণমূল নিপুণভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগালো। বিষয়টি এত ভালভাবে কাজ করেছিল যে এক পর্যায়ে, অমিত শাহও স্পষ্ট করে বলতে বাধ্য হন "কোনও গুজরাটি বাংলায় সরকার গঠন করবে না, বাঙালি ছাড়া।"
করোনাভাইরাস মহামারিতে অব্যবস্থাপনা
ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম রাজ্য জরিপ হিসেবে নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে একটি আট-পর্বের নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জরিপের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিজেপিকে সহায়তা করার আশ্বাস পাওয়া গেলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সব ভেস্তে যায়। মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গের সাথে লড়াইয়ে ভারতের সাথে সাথে বিজেপিও ব্যর্থ হয়েছে।
এরপরও মোদি এবং শাহ দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাটের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পালনের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে তাদের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। একজন নিঃস্বার্থ নেতা হিসেবে বিজেপির পাশাপাশি মোদির ভাবমূর্তির উপরেও তা বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন মোদি এবং শাহ প্রচারণা শুরু করেন। নবীন বিজেপি বেঙ্গল ইউনিটের দরকার ছিল দলের কেন্দ্রীয় ইউনিট। এ কারণেই দিল্লিতে সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলেও মোদি-শাহ প্রচারণা চালিয়ে গিয়ে এত বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
বিজেপির বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়েই তৃণমূল নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে “খেলা হবে” কৌশল কাজে লাগায়। আর আশ্চর্যজনকভাবে, শেষ দুই পর্বে তৃণমূল সত্যিই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছে।
মতামত দিন