কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকায় এক শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া দীর্ঘ ৫২ মাস ধরে চলমান এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে প্রায়শই মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ইতিহাসবিদদের মধ্যে
আধুনিক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম, করুণ বিষাদগাঁথা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু অবলোকন করা এই মহাযুদ্ধে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে লক্ষাধিক মানুষ। তার থেকেও বেশি মানুষ স্বামী ও পিতৃহারা হয়েছে। এমন একটি অস্পষ্ট পরিসংখ্যান দিয়েই ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও বীভৎসতাকে পরিমাপ করা হয়ে থাকে।
১ম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার রেড আর্মি থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম বলশেভিক যোদ্ধারা। ছবি: এএফপি।
কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকায় এক শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া দীর্ঘ ৫২ মাস ধরে চলমান এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে প্রায়শই মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ইতিহাসবিদদের মধ্যে।
১৯১৬ সালের জুনে মেসোপটেমিয়ার ডিয়ালা ব্রীজ অতিক্রম করছে ব্রিটিশ সেনা সদস্যরা। ছবি: এএফপি।
সম্প্রতি এএফপি যেসব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মতৈক্য বিদ্যমান সেগুলোর উপর সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান নিয়ে একটি সংকলন তৈরি করেছে।
যুদ্ধে লিপ্ত ছিল ৭০টিরও বেশি দেশ
এমনকি, উপরোক্ত এই পরিসংখ্যানটিও বিভ্রান্তিমূলক। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই ৭০টি দেশের বাইরেও বর্তমানে স্বাধীন অনেক দেশ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তৎকালীন মহাশক্তিধর ৬টি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে তখনও স্বাধীনতা লাভ না করায় বর্তমানে স্বাধীন এই রাষ্ট্রগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই ৭০টি দেশের তালিকায় স্থান পায়নি। এইসব দেশগুলো তখন অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া (বর্তমান জার্মানি), ফ্রান্স এবং অটোমান ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের কাছে পরাভূত ছিল।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালের ১১ নভেম্বর আরমিস্টিস চুক্তির প্রাক্কালে ফ্রেঞ্চ মার্শাল ফেরদিনান্ড ফোক এবং মার্কিন জেনারেল জন জে পারশিং। ছবি: এএফপি।
মোট ৭০টি রাষ্ট্র অংশগ্রহণ করলেও, ১২ টি স্বাধীন দেশ এই ঔপনিবেশিক জটিলতার কারণেই ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহতার সূচনা করেছিল। যুদ্ধের তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশগুলি পরবর্তীতে যুদ্ধে সামিল হয়। উদাহরণসরূপ বলা যেতে পারে ইতালি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের নাম। উল্লেখ্য, ইতালি যুদ্ধ শুরু হবার ১ বছর পর ১৯১৫ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৭ সালে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
সৈন্য সংখ্যা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের ৮০ লক্ষ, জার্মানির ১ কোটি ৩০ লক্ষ, আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ৯০ লক্ষ এবং ইতালির ৬০ লক্ষ সৈন্য অংশগ্রহণ করে।
অন্যদিকে ব্রিটেন ৯০ লক্ষ সৈন্যকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে তাদের উপনিবেশের অন্তর্গত বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এর অধিকাংশই ছিল ভারত থেকে আগত। যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে ৪০ লক্ষ সৈন্য নিযুক্ত করেছিল।
মৃত সৈনিকের সংখ্যা ১ কোটি
বীভৎস এই যুদ্ধে জার্মানি এবং রাশিয়াতে মৃত্যুর মিছিলটা সবচেয়ে দীর্ঘ। এমনকি, আহতের সংখ্যাটাও এই দুটি দেশেই সবচেয়ে বেশি ছিল। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট ১ কোটি সৈনিক মৃত্যুবরণ করে এবং আহত হয় তার দ্বিগুন সংখ্যক মানুষ।
এখানে অংশগ্রহণকারী প্রধান দেশগুলোর মৃত এবং আহত সৈনিকদের একটি স্থুল পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো।
অংশগ্রহণকারী দেশ | মৃত্যু | আহত |
রাশিয়া | ২০ লক্ষ | ৫০ লক্ষ |
জার্মানি | ২০ লক্ষ | ৪২ লক্ষ |
ফ্রান্স | ১৪ লক্ষ | ৪২ লক্ষ |
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি | ১৪ লক্ষ | ৩৬লক্ষ |
ব্রিটেন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য | ৯.৬ লক্ষ | ২০ লক্ষ |
ইতালি | ৬ লক্ষ | ১০ লক্ষ |
অটোমান সাম্রাজ্য | ৮ লক্ষ | অনির্ধারিত |
যুক্তরাষ্ট্র | ১.১৭ লক্ষ | অনির্ধারিত |
সেনাবাহিনীর আয়তনের সাপেক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল সার্বিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের মৃতের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩০ হাজার এবং আহত হয়েছিল সার্বিয়ার ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষ যা ছিল তাদের সমগ্র সেনাবাহিনীর তিন-চতুর্থাংশ।
যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে মৃত্যুর সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি ছিল। উদাহরনসরুপ বলা যেতে পারে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর কথা। ১ম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে, ১৯১৪ সালের ২২ আগস্ট একই দিনে ফরাসী সেনাবাহিনীর ২৭,০০০ সদস্য মৃত্যুবরণ করে। এটি এখনও ফরাসী সেনাবাহিনীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন হিসেবে বিবেচিত হয়।
যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র
যুদ্ধের ৭০% ক্ষতির কারণ কামানের গোলা। এই কামান ব্যবহারের কারণে ৫ থেকে ৬ লক্ষ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনীর কামানের গোলায় বিধ্বস্ত ফ্রান্সের আমিয়েন্স গ্যালারি। ছবি:এএফপি।
এই যুদ্ধেই প্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যপক ব্যবহার করা হয়। জার্মানি বেলজিয়ামের ইয়েপ্রেসে ১৯১৫ সালে যুদ্ধাত্র হিসেবে সর্বপ্রথম ক্লোরিন গ্যাস ব্যবহার করে। পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার কেড়ে নেয় ২০ হাজার মানুষের জীবন।
লক্ষ লক্ষ সাধারণ নাগরিকের প্রাণহানি
ভয়ংকর এই যুদ্ধের ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে, এটার কোন সঠিক পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত নির্ণয় করা যায়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর এই পরিসংখ্যানে যারা প্রকৃত যুদ্ধে মারা গেছে তাদের পাশাপাশি যারা জোরপূর্বক উৎখাত, যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এবং রাশিয়া, তুরস্ক ও পূর্ব-ইউরোপের গৃহযুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কোন কোন ইতিহাসবিদ দাবী করেন যে, অটোমান সাম্রাজ্যে ১২ থেকে ১৫ লক্ষ আর্মেনিয়ানদের হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে, যুদ্ধের শেষ দিকে স্পেন থেকে উদ্ভূত একটি ইনফুয়েঞ্জা সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্প্যানিশ ইনফ্লুঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ।
যুদ্ধের অন্যান্য পরিসংখ্যান
- এই যুদ্ধে ৬০ লক্ষ মানুষ যুদ্ধবন্দী হয়।
- যুদ্ধের কারণে ১ কোটি মানুষ গৃহহারা হয়।
- ৩০ লক্ষ নারী এই যুদ্ধের কারণে বিধবা হয় এবং অনাথ হয় ৬০ লক্ষ শিশু।
- এই যুদ্ধে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন কামানের গোলা ব্যবহার নিক্ষেপ করা হয়।
- এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রায় ১০ লক্ষ চিঠি যুদ্ধরত সৈনিক ও তাদের প্রিয়জনের মধ্যে বিনিময় হয়েছে।
মতামত দিন