পুরনো ঢাকার সেসময়ের বাসিন্দারা নাকি বুড়িগঙ্গা থেকে রাতে কামানের গর্জন শুনতেন। এই মিথ আবার প্রেম জড়ানো
অনেক অনেক যুগ পেরিয়েও মানুষের মুখে মুখে যেসব গল্পের প্রচলন থাকে সেগুলোই মিথ। ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি মিলে মিশে থাকে এতে। নানা নেতিবাচকতায় প্রতিদিন আলোচিত রাজধানী ঢাকার নানা বিষয় নিয়েও বিরাজমান ছিল বহু মিথ ছিল। যে শহরটি এক কথায় বুড়িগঙ্গা পাড়ের ছোট্ট “৫২ বাজার , ৫৩ গলির শহর”।
প্রকাণ্ড মেগাসিটি হয়েছে এখনকার ঢাকা। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নের উত্তেজনায় অনেকেই টের পাননি কখন ঢাকার মিথগুলো হারিয়ে গেছে।
এ লেখনীতে থাকছে তারই চারণ।
বাবুবাজারের এক শহীদ পাগল
বাংলাদেশের সব গ্রাম অথবা এলাকায় একজন করে পাগল আছে। প্রয়াত মায়েস্ত্রো লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলতেন এ কথা।
১৯৭১ সালে পুরান ঢাকার বাবুবাজারে এমন একজন ছিলেন। মার্চে অসহযোগ আন্দোলন তখন তীব্র হচ্ছিল। বাবুবাজারের নাম না জানা এই পাগলের কর্মকাণ্ড তখন একটু বেশি মাত্রায়। তার পাগলামীর যাবতীয় অনুষঙ্গের সাথে যুক্ত হয় উচ্চকণ্ঠে “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করে ওঠা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে শহরবাসী ঢাকা ছাড়তে থাকে। কিন্তু নির্বিচার গণহত্যার নৃশংসতা বাবুবাজারের পাগলকে স্পর্শ করে না। তিনি এলাকায় থেকে যান।
এপ্রিলের একদিন বাবুবাজারে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনাবহর। কি কারণে জানি পাগল মানুষটি এতে উল্লাসিত হয়ে ওঠেন। সেনাবহরের সামনে গিয়ে সে চিৎকার করে “জয় বাংলা” বলে। মুহূর্তেই মেশিনগানের গুলিতে নিথর হয় তার দেহ।
দেশ স্বাধীন হয়। গণহত্যায় শহীদ লাখো মানুষের কজনকে কে মনে রেখেছে? কিন্তু বাবুবাজারের মানুষকে মনে রাখতে হয়। স্বাধীনতার পর বাবুবাজারের রাস্তায় গভীর রাতে অনেকে এই পাগলকে হাঁটতে দেখতেন।
টিপু সুলতান রোডের আদি বাসিন্দা মুহাম্মদ নাসিরুল্লাহর মুখে এই গল্প শুনেছি। নিজে কখনও এই পাগলকে দেখেননি তিনি। কিন্তু অপমৃত্যুর শিকার কাউকে নিয়ে আমাদের সমাজে যে জনশ্রুতি তৈরি হয়, কারও দেখা, না দেখায় এর মিমাংসা হয় না।
পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের জিন-পরীরা
১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে প্রাণচাঞ্চল্য পায় পূর্ববঙ্গ। নতুন প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলার। এর আগে তিনি আসামের চিফ কমিশনার ছিলেন। প্রশাসনিক কাজে ফুলার তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯০৬ সালের জানুয়ারিতে। এর আগে তার জন্য অফিস ও বাসভবন নির্মিত হয়। যেটি আজকের দিনে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন নামে পরিচিত।
কিন্তু এই ভবনে ব্যামফিল্ড ফুলার বেশিদিন থাকতে পারেননি। কথিত আছে, তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এ ভবন ত্যাগ করেন। মাঝরাতে প্রায়ই নাকি লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ঘুম ভেঙে যেত। তিনি নিজেকে ঘরের মেঝে বা বারান্দায় দেখতে পেতেন। আবার সকালে নাকি তিনি তার ঘরের আসবাবপত্র ওলট-পালট অবস্থায় দেখতে পেতেন।
পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটি যেখানে অবস্থিত , মুঘল আমলে এই এলাকার নাম ছিল “মহল্লা চিশতিয়া”। এ এলাকার একাংশে ছিল কবরস্থান। এ মিথে আস্থাশীলরা মনে করেন, একজন দরবেশের কবরের ওপর লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অফিস ও বাসভবন নির্মিত হয়েছে। নাখোশ জিন-পরীরা তাই এমন করে শায়েস্তা করেছে ফুলারকে।
তবে ভারত সরকারের কনসাল্টিং আর্কিটেক্টের কাছে জিন-পরীরা পাত্তা পায়নি। তার ভাষ্য ছিল, লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসস্থানটি নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। সেসময় বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকা ছিল উত্তেজনাপ্রবণ। স্বদেশি ও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। ছিল নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি। ফুলারের বাসভবন ত্যাগের কারণ হয়ত সেটিই।
লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গ
১৬৭৮ এ শাহাজাদা মুহাম্মদ আজমের হাতে লালবাগ কেল্লার নির্মাণ শুরু। অসমাপ্ত অবস্থায় ১৬৮৮ সালে নির্মাণ শেষ। এখনের শহরের অন্যতম দম ফেলার এ জায়গায় বিস্তৃত বাগান,পরী বিবির মাজার, মুঘলদের রাজকীয় হাম্মামখানা। কিন্তু সব ছাপিয়ে লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গ নিয়ে ঢাকাবাসীর জল্পনা কল্পনা চলেছে দীর্ঘদিন। এখন কর্তৃপক্ষ সব সুড়ঙ্গ বন্ধ করে দিয়েছে। কারও মতে, কেল্লার সুড়ঙ্গ বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে জিঞ্জিরা প্রাসাদে মিলেছে। আবার কারও মতে মুর্র্শিদাবাদ পর্যন্ত এ সুড়ঙ্গ বিস্তৃত। অনেক মানুষ সুড়ঙ্গের ভেতর হারিয়েও গেছেন। এরপর মৃত মানুষদের নিয়ে নতুন মিথের সূত্রপাত। সুড়ঙ্গ থেকে নাকি নানারকম শব্দ ভেসে আসত। ইত্যাদি ইত্যাদি...।
হোসেনী দালানের পুকুর
১৬৪২ সালের কথা। স্বপ্নে “ইমাম হোসেনের নির্দেশ” পেয়ে কারবালার স্মৃতি স্মরণে মীর মুরাদ নির্মাণ করেন হোসেনী দালান। আজকের শহরের চানখারপুলে এর অবস্থান। মীর মুরাদ ছিলেন তৎকালীন নিজামতের রণতরীর প্রধান। হোসেনী দালান নির্মাণকালে ভবনের দক্ষিণ দিকে একটি বিশাল পুকুর কাটা হয়। মীর মুরাদের পরিকল্পনায় পুকুরটির একটি প্রতীকী অবস্থান ছিল। ফোরাত নদীর তীরে ইমাম হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে এই জলাধারের তুলনা সম্পর্কীত। কিন্তু এই হোসেনী দালান সংলগ্ন এই পুকুরটিকে নিয়ে ঢাকায় জনপ্রিয় মিথ তৈরি হয়।
কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতিকথা “স্মৃতির শহর” থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, “হোসেনী দালানের পুকুরটার সামনে দাঁড়ালে কেমন গা ছমছম করতো। পুকুরের পানি দেখতে তেমন ভালো ছিল না। কেমন মরা, সবুজ, সবুজ। ছাতলা পড়া। মনে হতো, পানি থেকে আজগুবি একটা জানোয়ার ঝপ করে উঠে এসে খপ করে ধরে ফেলবে আমাকে। ভয়ে বুক শুকিয়ে উঠত, ভীষণ তেষ্টা পেত তখন। ভয়ের কারণও ছিল। পুকুরটার একটা বদনাম আছে। প্রতিবছর হোসেনী দালানের পুকুর ‘ভোগ’ নেয় বলে আগেই শুনেছিলাম। কেউ না কেউ প্রতিবছর ডুবে মরত ওই পুকুরে । শুনেছি , রাতদুপুরে ইয়া বড় বড় ‘ডেগ’ অর্থ্যাৎ তামার মস্ত হাড়ি ভেসে ওঠে হোসেনী দালানের পুকুরের মরা সবুজ-সবুজ পানির উপর।”
বংশালের পুকুর নিয়েও এমন গল্প প্রচলিত ছিল পুরান শহরে। সম্ভবত এমন গল্প ছাড়া কোনো পুকুরই “জাতে” ওঠে না বাংলাদেশে!
গুলিস্তানের কামান
গুলিস্তানের কামান নিয়ে মিথ আছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন রচিত “ঢাকার হারিয়ে হারিয়ে যাওয়া কামানের খোঁজে” বই থেকে ঢাকার কামান নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
মুঘল আমলে ব্যবহৃত যেসব কামান অষ্টাদশ শতকে ছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি। একটির নাম বিবি মরিয়ম। এটিই এখনের ওসমানী উদ্যানে রাখা কামান। অপরটি “কালে জমজম” বা “কালে খাঁ” নামে পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, কালে খাঁ এক সময় বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যায়।
ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট ও গ্রন্থকার ডি. আয়লির মতে সপ্তদশ শতকে বারবার মগ বা আরাকান হামলা ঠেকাতে কামান দুটি নির্মিত হয়। সম্ভবত মুঘল প্রকৌশলীদের নির্দেশনায় দেশীয় কারিগররা তা তৈরি করেন। কারণ, এত ভারি কামান জলপথে আনা সম্ভব নয়। এমন যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে ঢাকাবাসীর ধারণা ছিল না। অনেকে মনে করত, এটি স্বর্গ থেকে পতিত হয়েছে। ঢাকার সনাতন ধর্মের অনেকে এই কামানকে পুজাও করেছেন এ বিশ্বাস থেকেই।
১৭৮০ সালে কালে খাঁ বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যায়। কালে খাঁ বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার পর বিবি মরিয়ম নিয়ে ঢাকাবাসী আগ্রহী হয়ে ওঠে। মীর জুমলা বিবি মরিয়মকে স্থাপন করেন বড় কাটরার সামনে সোয়ারীঘাটে। ১৮৪০ এ ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টারস্ সোয়ারীঘাট থেকে বিবি মরিয়মকে বসান চকবাজারে।
ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর হয়ে কামানটি নিয়ে যান সদরঘাট। পাকিস্তান আমলে রাখা হয় নতুন এলাকা গুলিস্তানে। এখন এর ঠাঁই ওসমানী উদ্যানে।
পুরনো ঢাকার সেসময়ের বাসিন্দারা নাকি বুড়িগঙ্গা থেকে রাতে কামানের গর্জন শুনতেন। এই মিথ আবার প্রেম জড়ানো। ঢাকাইরা মনে করতেন, বুড়িগঙ্গায় হারানো কামান কালে খাঁ তার সঙ্গিনী বিবি মরিয়মকে ডাকছে!
ভিক্টোরিয়া পার্কের ভূত
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভিক্টোরিয়া পার্কে আর্মেনিয়ানদের একটি ক্লাব ছিল। তারা এখানে বিলিয়ার্ড খেলত। স্থানীয় ঢাকাইয়ারা বিলিয়ার্ড বলকে “আন্ডা” বলত। ভাষা বিবর্তনে আর্মেনিয়ান ক্লাবের নাম হয়ে যায় “আন্টাঘর”। ক্লাব সংলগ্ন মাঠটিকে ডাকা হত “আন্টাঘর ময়দান”।
সময়টা তখন সিপাহী বিদ্রোহের। ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর ভোর ৫টায় ইউরোপিয়ান স্বেচ্ছাসেবক ও শতাধিক নৌ-সেনার সমন্বয়ে একটি দল এই ময়দানে এসে দাঁড়ায়। এদের একটি দল মার্চ করে ট্রেজারির (সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগার) দিকে যায়। আরেকটি দল ছোটে লালবাগ কেল্লার দিকে। বিদ্রোহী সিপাহীদের সঙ্গে শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। সিপাহীদের অনেকে যুদ্ধ করে শহীদ হন। কেউ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। অধিপতি ব্রিটিশরা গ্রেপ্তার ও বিদ্রোহে জড়িত ঢাকাবাসীর একটি দলকে সদরঘাটে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেয়। প্রহসনমূলক বিচার করে বাকি বিদ্রোহীদের আন্টাঘর ময়দানের বৃক্ষসারিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। বহুদিন যাবত এদের লাশ ঝুলে থাকায় পচাগন্ধে সেই এলাকা দিয়ে মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।
এ ঘটনায় যে মিথের জন্ম তার বিবরণ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “ফেরারী” গল্পে পাওয়া যায়। “খিজির মিস্ত্রি বলে, “আমাগো বাপ-দাদায় বহুত কইছে, রাইত হইলে ঐ ময়দানের বগলেও ভি যাইবি না। আন্টাঘর ময়দানের মইদ্যে অহন ভিক্টোরিয়া পার্ক কয় না? হেই ময়দানের মইদ্যে গাছগুলির লগে লটকাইয়া ফাঁসি দিছিলো সিপাইগো। চান্দের রোশনী ছাড়লেই সিপাইগুলি মাথার লগে লাল নীল লাইট না ফিট কইরা মহল্লা জুইড়া খালি নাইচা বেড়ায়।”
সিপাহী বিদ্রোহে দেশবাসীর রক্তের সাথে বেঈমানী করে “নবাব” খেতাব লাভ করেন লবণ ব্যবসায়ী খাজা আবদুল গনি। ঢাকার আদি অধিবাসীদের ওপর এই “কাগুজে নবাব” পরিবারের দাপটের সূচনা এ সময় থেকেই।
সিপাহী বিদ্রোহ দমন শেষে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আহসান মঞ্জিলে ব্যাপক আমোদ-প্রমোদের আয়োজন করা হয়। শোকে স্তব্ধ ঢাকা প্রত্যক্ষ করে আলোকসজ্জিত আহসান মঞ্জিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ ঢাকাবাসীর সাথে সম্পর্কহীন এই মঞ্জিল থেকে শোনা যায় বাইজী নুপুরের আওয়াজ।
এখানেই শেষ না। সিপাহী বিদ্রোহে নিহত ইংরেজ সৈন্যদের স্মরণে আন্টাঘর ময়দানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এ নির্মাণেও ঢাকার নবাব পরিবার উদ্যোগী হয়েছিল।
নবাব পরিবারের স্ফূর্তিতে সিপাহীদের রক্তে ভাসা শহর মাতেনি। আন্টাঘর ময়দান সংশ্লিষ্ট এলাকায় শহীদ সিপাহীদের নিয়ে ভুতের গল্প চালু হয়ে যায়। মানুষের মুখে মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুতের গল্প হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে রক্তাক্ত ইতিহাস।
১৯৭৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় “কিংবদন্তির ঢাকা” বইটি। লেখক নাজির হোসেন এই বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখেন :
“১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকালে লালবাগ দুর্গের সিপাহীদের সাহায্য করতে গিয়ে আমলীগোলা ও লালবাগ অঞ্চলের যেসব মহলল্লাবাসী আন্টাঘর ময়দানের বৃক্ষসারিতে সিপাহীদের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন এবং যারা নানাভাবে লাঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন তাদের স্মরণে।”
আমলীগোলা মহল্লা এখন “জগন্নাথ সাহা রোড” নামে পরিচিত। পুরনো শহরের গতানুগতিক একটি বাণিজ্যিক এলাকা। ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় আত্মাহুতির কোনো স্মারক এখানে সরেজমিনে গিয়ে মেলে না।
সব মিলিয়ে চোখের সামনে আমাদের শহর হারাচ্ছে এর ঐতিহ্য। সঙ্গে আরও আগে বিলুপ্ত হয়েছে বহু মিথ।
একজন নিবিড় কবির জন্য তা সহ্য করা কঠিন। হয়তো নস্টালজিক ঘোরেই সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক লিখে ছিলেন,
“... কী নাম এ শহরের?
কারা থাকে এইসব ডিজাইনড বাড়িতে?
আজকাল প্রত্যেকের নামের পেছনে কেন এত ডাক নাম?
মানুষের হাসিটি এখন হঠাৎ হর্নের মতো কেন মনে হয় কবিতার মধ্যরাতের সময়ে?
টয়োটার মিৎসুবিশির ভিড়, মরিস মাইনরগুলো ডিনোসোরাসের মতো মাটি চাপা পড়ে গেছে; বুজে গেছে দোলাই কানাল; ... ”
-ঢাকায় প্রথম বসতি, আমার শহর কবিতার বই থেকে
অথচ আমাদের শহরটি কী গর্বেরই না ছিল! ১৮৪০ সালে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল ডেভিডসন ঢাকায় আসেন। তার ডায়েরিতে এ শহরের বিবরণ লিখেছেন। দিনে-রাতে ঢাকায় বেহালার শব্দ শোনা যেত। ঢাকাবাসীকে তিনি উল্লেখ করেছেন “মিউজিক্যাল পিপল” হিসেবে।
হৃদয়নাথ মজুমদার নামে ঢাকার এক আইনজীবী তার স্মৃতি কথায় শহরের সেতার ও তবলার বাদন ঘরানার বন্দনা করেছেন।
ইন্দ্রবালা ঢাকায় গান গাইতে আসার আগে কালীঘাটের মন্দিরে প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “মা ঢাকা যাচ্ছি। ঢাকা তালের দেশ।. . মান রাখিস মা । ”
আজকের দুর্বিষহ ট্রাফিক জ্যাম, নদী, খাল ভরাটসহ নানা নাগরিক সমস্যায় জর্জরীত শহরে তা রূপকথা মাত্র।
শতবর্ষে আগের কোনও কবির বর্ণনায় ঢাকার ভৌগোলিক সীমানা পাওয়া যায় এমন
“পুরব তরফ হ্যায় লোহা কা পাল্লা
পচছম তরফ হ্যায় লালবাগ কা কেল্লা
উত্তর তরফ হ্যায় লোহা কা রেল্লা
দক্ষিণ তরফ হ্যায় মহল আহসান উল্লাহ ”
অর্থাৎ পূর্ব দিকে লোহার পুল, পশ্চিমে লালবাগ কেল্লা, উত্তর দিকে লোহার রেল (ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন), দক্ষিণে আহসান উল্লাহর প্রাসাদ। এ সীমানা বহু আগেই পেরিয়েছে ঢাকা। এখন গড়ে উঠছে পূর্বাচল। অনেক “হাইটেক” সাজানোর আয়োজন একে নিয়ে। ঢাকা নদীকেন্দ্রিক নগর সভ্যতা বিলীন। হয়তো সত্যিকারের জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক উন্নয়ন ও বিনির্মাণে এ শহর বদলাবে। অবাসযোগ্য ও দূষণ শীর্ষের বৈশ্বিক তালিকা থেকে নাম কাটবে। কিন্তু আমাদের শহর কোনও দিন, কোনও কিছুতেই ফিরে পাবে না আর তার হারিয়ে যাওয়া মিথ। এ বাস্তবতায় দুঃখ তার নাম লেখে।
মতামত দিন