‘সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে ছিলেন’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সময়ের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে সবসময়ই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মুসা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “আমার বেলা যে যায়”-এ লিখেছেন “মুজিব ভাইয়ের চরিত্রের সবচেয়ে মধুর দিকটি ছিল তার সাথে পরিচিত প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা। সেই আন্তরিকতা এবং ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা শত্রু এবং মিত্ররা একইভাবে অনুভব করতে পারতো। তবে, সাংবাদিকরা তার হৃদয়ে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিল।”
একটি বিশেষ ঘটনা সাংবাদিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসাকে আরও সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পর, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান থেকে যুক্তরাজ্য এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছিলেন, তখন সাংবাদিক আতাউস সামাদ দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই ফ্লাইটে ছিলেন।
“ঢাকায় আসার পর সামাদ বলেছিলেন, বিমানে বঙ্গবন্ধু তাকে (সামাদ) সর্বপ্রথম তার পরিবার সম্পর্কে নয়, বরং প্রত্যেক সাংবাদিকের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যাদের তিনি চিনতেন। বঙ্গবন্ধু তাদের প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে জানতে চেয়েছিলেন তারা কেমন আছেন, এখন বেঁচে আছেন কি-না, এমনকি তাদের কথাও জানতে চেয়েছেন যারা তার সমালোচনা করেছেন,” লিখেছেন এবিএম মুসা।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র দু’দিন পর, ১২ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মালিকানাধীন সংবাদপত্র “মর্নিং নিউজ”-এর সম্পাদক বদরুদ্দিন আহমদের খোঁজ জানতে চাইলেন।
এবিএম মুসা’র মতে, “এই পত্রিকাটি সবসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খবর বানাত। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের কথা লিখেছিল। ভাষা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় পত্রিকাটির কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে বঙ্গবন্ধু বদরুদ্দিন আহমদকে খুঁজে বের করে এবং নিজ দায়িত্বে তার (বদরুদ্দিন আহমদ) নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।”
পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে লাহোরে আহমদের সঙ্গে এবিএম মুসার দেখা হলে, তিনি প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে কেঁদেছিলেন। কারণ একদিন বঙ্গবন্ধুই তার জীবন রক্ষা করেছিলেন।
১৯৭১ সালে আরেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য চাকরি হারান। জাতির পিতা নিশ্চিত করেছিলেন ওই সাংবাদিককে যেন তার পদে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
এমন সময়ও এসেছে, যখন বঙ্গবন্ধু তার মন্ত্রীদের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের নিজের বুদ্ধি এবং হাস্যরসের মাধ্যমে রক্ষা করেছিলেন।
একদিন সন্ধ্যায় গণভবনে, তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে আসেন এবং সরকারি বিজ্ঞাপন সংক্ষিপ্ত করায় সে সময়ের দৈনিক জনপদ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরী তাকে “সরাইল হাউন্ড” বলেছিলেন বলে অভিযোগ করেন।
জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “গাফফার, তোমার তাকে সরাইল হাউন্ড বলা উচিত হয়নি। কুকুর অনেক ধরনের আছে। সরাইল শাবকগুলো লম্বা, পাতলা এবং হিংস্র, আলসেশিয়ানের মতো। অন্যদিকে, বুলডগগুলোর মোটা এবং গোলাকার মুখ থাকে যা রেগে গেলে লালচে হয়ে যায়।”
সেখানে উপস্থিত মুসা, গাফফারসহ অন্যান্য সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে যখন হাসি আটকানোর চেষ্টা করছিলেন তখন ক্ষুব্ধ ঠাকুর, যিনি দেখতে বেশ মোটা ছিলেন, দ্রুত সেখানে থেকে চলে যান।
বঙ্গবন্ধু তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তবে, আপনাদের কোনো মানুষের শারীরিক গঠন নিয়ে সমালোচনা করা আসলে উচিত নয়।”
বেবি মওদুদের “বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার” বইয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের আগে চারটি সংবাদপত্র বন্ধ করার জন্য জাতির পিতা কখনও কখনও সমালোচিত হয়েছেন। তারপরেও তখন যেসব সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন তারা নতুন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত যেন বেতন পান সে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত করেছেন।
মতামত দিন