লবণাক্ততা উপকূলবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার একটি বিরাট কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে এবং তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা
বর্তমানে দেশের সমুদ্র নিকটবর্তী প্রায় ১৯ জেলায় মোট ৩.৯ কোটি মানুষের বসবাস। যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার শিকার। মূলত ঘনঘন ঝড় ও জলচ্ছ্বাসের পাশাপাশি সমুদ্রের উচ্চ জোয়ারে প্রতি বছর উপকূলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশই এর প্রধান কারণ এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে দেশে মোট লবণাক্ত জমির পরিমান ছিল প্রায় ৮৩.৩ মিলিয়ন হেক্টর যা ২০০০ সাল প্রর্যন্ত বেড়ে দাড়ায় ১০২ মিলিয়ন হেক্টরে এবং ২০০৯ এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১০৫.৬ মিলিয়ন হেক্টরে। শতাংশের হিসেবে বিষয়টি গত ৩৫ বছরে প্রায় ২৬% বেড়েছে এবং এতে স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি লবণাক্ততা উপকূলবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার একটি বিরাট কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে এবং তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা।
খুলনার দাকোপ উপজেলাবাসীর ওপর করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, সেখানকার নারীরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে প্রায় ১৮ থেকে ২০ গুন বেশি লবণ গ্রহণ করছেন। ফলশ্রুতিতে তারা অতিরিক্ত মাত্রায় হাইপার টেনশন, ঋতুচক্রকালীন স্বাস্থ্য জটিলতা ও গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
দাকোপ উপজেলা সদর হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গর্ভকালীন হাইপার টেনশন নিয়ে ভর্তি হওয়া প্রসূতি মায়ের সংখ্যা প্রায় ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমুদ্র নিকটবর্তী জেলা খুলনায় রয়েছে মিঠাপানির সংকট। ফাইল ছবি/ঢাকা ট্রিবিউন
অন্যদিকে, দেশে ১২,৮৬৭ জন গর্ভবতী মায়ের ওপর করা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিস রিসার্সের গবেষণায় বলা হয়, দেশের সমুদ্র দূরবর্তী সমতল ভূমির নারীদের তুলনায় লবণাক্ততার কারণে সমুদ্র তীরবর্তী নারীদের গর্ভপাতের পরিমাণ অনেক বেশি। পাশাপাশি শিশুদের নিয়ে করা আর একটি গবেষণা তথ্যমতে, লবণাক্ততার পরিমাণ ৫ থেকে ৯৫% বেড়ে গেলে শিশুমৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ৩০% পর্যন্ত বাড়ে। যা আমাদের উপকূলীয় জেলাগুলোর জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এদিকে, কৃষিতে বাংলাদেশের মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৩০%। সমুদ্রবর্তী জেলাগুলিতে এরই মধ্যে প্রায় ৫৩% জমি লবণক্ততার শিকার হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ তাদের নিয়মিত পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন।
আমেরিকান জার্নাল অব এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশনের পরিসংখ্যান তথ্য বলছে, গত ১৫ থেকে ২০ বছরে লবণাক্ত জেলাগুলোতে কৃষিকাজে মানুষের অংশগ্রহণ ৫৭% থেকে কমে ১৩%-এ নেমে এসেছে এবং অ-কৃষি পেশা গুলিতে অংশগ্রহণ ১৯% থেকে বেড়ে ৬৩%-এ গিয়ে ঠেকেছে। পাশাপাশি বর্তমানে কাজ হারানো ও অ-লবণাক্ত জেলাগুলোর সঙ্গে মজুরির বড় ব্যবধানের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৬৭ শতাংশের বেশি মানুষ জীবিকা ও সুন্দর জীবনের সন্ধানে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা ও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
এখন পর্যন্ত বিষয়টি সহ্যসীমার মধ্যে থাকলেও সামনের দিনগুলোতে লবণাক্ত এলাকার পরিমাণ বাড়লে সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
২০১৮ সালে ইনটেক ওপেনের প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জমিগুলোর উচ্চতা মাত্র ১ থেকে ২ মিটার এবং দক্ষিণ-পূর্বের জমিগুলোর উচ্চতা ৩ থেকে ৪ মিটার। ফলে বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা সামান্য বাড়লই আমরা আমাদের ভূ-খণ্ডের একটি বড় আংশ হারিয়ে ফেলতে পারি। পাশাপাশি কক্ষপথে চাঁদের অবস্থান পরিবর্তনে সমুদ্রের জোয়ারে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়াও আমাদের মতো প্লাবন সমতল ভূমির দেশের জন্য বিরাট দুঃশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। নাসার মতে, চাঁদের এই অবস্থান পরিবর্তনের ফলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী ঘন ঘন ভয়াবহ বন্যার শিকার হতে পারে। যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলো।
মতামত দিন