হন্যে হয়ে তারা ছুটে বেড়াচ্ছে একটু খাবারের আশায়। কিন্তু হায়! ডাস্টবিনেও যে উচ্ছিষ্ট নেই
করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে দেশজুড়ে চলছে সাধারণ ছুটি। বন্ধ হয়ে গেছে অফিস-আদালত থেকে শুরু করে বেশিরভাগ দোকানপাট। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে মানুষ যেমন বিপদগ্রস্ত তেমনি বিপাকে পড়েছে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো প্রাণীরা বিশেষ করে কুকুর-বিড়ালরা। মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টে ওদের জীবন বাঁচে।
খাবার দোকান বন্ধ, নগরীতে নেই মানুষের আনাগোনা। কে ওদের খাবার দেবে? গত ২৬ মার্চ থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই সাধারণ ছুটিতে নিরীহ প্রাণীগুলোকে থাকতে হচ্ছে অভুক্ত। হন্যে হয়ে তারা ছুটে বেড়াচ্ছে একটু খাবারের আশায়। কিন্তু হায়! ডাস্টবিনেও যে উচ্ছিষ্ট নেই!
এই প্রাণীগুলো মূলতঃ বেঁচে থাকত হোটেল-রেস্টুরেন্টের ফেলে দেওয়া পচা-বাসি খাবার আর উচ্ছিষ্ট খেয়ে। কিন্তু বর্তমানে সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র হোম ডেলিভারি সার্ভিস দিচ্ছে।
চলমান এই সঙ্কটে তাদের জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে সরকার।
করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালে রাস্তার এসব অভুক্ত প্রাণীর জন্য খাদ্য সরবরাহে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই বলে ঢাকা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, রাস্তায় থাকা প্রাণীদের খাবার দেওয়ার জন্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসতে প্রাণীপ্রেমিদের প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।
অবশ্য অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইতোমধ্যে এসব প্রাণীকে খাবার দিচ্ছেন। তবে দিন দিন বিষয়টি তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ারের (পিএডব্লিউ) চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল বলেন, “ছুটির মেয়াদ আরও বাড়লে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর জন্য এই প্রাণীগুলোকে খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনে প্রায় ৬০ হাজার মালিকবিহীন কুকুরের বসবাস। গত বছর অধিদপ্তরের উদ্যোগে ৪৮ হাজারেরও বেশি কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
কুকুর-বিড়াল ছাড়াও চলমান এই সঙ্কটে অভুক্ত আছে বানর, ইঁদুর, কাক, দোয়েল ও চড়ুইয়ের মতো প্রাণীরা।
অভুক্ত প্রাণীদের জন্য কিছু মানুষের সংগ্রাম
প্রাণীপ্রেমি ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভুক্ত থাকা প্রাণীদের খাবার দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে- পিএডব্লিউ, ইকো-সেভার্স ফাউন্ডেশন ও রবিন হুড দ্য অ্যানিম্যাল রেসকিউয়্যারের মতো সংগঠনগুলো।
আর ব্যবসায়ী অর্পিতা খান মহুয়ার মতো কিছু মানুষের উদ্যোগে চালু করা হয়েছে “ফুড ফর স্ট্রিট অ্যানিম্যালস” নামে একটি কর্মসূচি।
এর আওতায় প্রতিদিন রাজধানীর বারিধারা, নর্দ্দা, কুড়িল, এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন, নিকুঞ্জ ও কালাচাঁদপুর এলাকার সাড়ে তিনশ’রও বেশি কুকুরকে খাবার দেওয়া হচ্ছে।
মহুয়া জানান, প্রতিদিন এজন্য ব্যয় হয় প্রায় ৪৫০০ টাকা
তবে আরেকটি শঙ্কার কথাও জানান পিএডব্লিউ চেয়ারম্যান এমিল। তার মতে, কুকুরগুলোকে আমদানিকৃত শুকনো খাবার দেওয়া হলে সঙ্কট পরবর্তী সময়েও তারা সচরাচর উৎস থেকে পাওয়া খাবারগুলোর প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়বে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় কুকুর, বিড়াল, কাক, দোয়েল, চড়ুই ও গুইসাপকে খেতে দেন “ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ অর্গানাইজেশন”-এর পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবী।
ধানমন্ডির পিলখানায় ৪০টি ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ১৫০টি বানরকে খাওয়াচ্ছেন ইকো সেভার্স ফাউন্ডেশনের সদস্যরা।
ইকো সেভার্সের চেয়ারম্যান সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম মিঠু জানান, “আমার পদক্ষেপ দেখে তরুণ প্রজন্মও প্রাণীদের কল্যাণে এগিয়ে আসছে।”
ক্ষুধার্ত বানরকে খাবার দিচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবী। ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন
প্রাণীদের সম্পর্কে আরও সচেতনতা বাড়াতে সরকারের উচিত বিষয়টিকে পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, বলেন তিনি।
রাজধানীতে এসব সংগঠন ও ব্যক্তিরা ছাড়াও আরও অনেক মানুষ রাস্তার প্রাণীদেরকে সাধ্যমতো খাবার দিচ্ছেন নিয়মিত। আর রাজধানীর বাইরে খুলনা ও যশোরের কুকরদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছে পিএডব্লিউ।
তবে এই উদ্যোগ কতদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে শঙ্কিত তারা সবাই।
প্রাণীদের বেঁচে থাকার বিভিন্ন নিয়ামক
এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে এসব প্রাণী কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে ভেটেরিনারি চিকিৎসক সুশ্যাম বিশ্বাস ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “এটা নির্ভর করে প্রাণীটির বয়স এবং শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যের ওপর।”
“প্রতিদিন অন্তত একবেলা খাবার তাদেরকে এই জরুরি পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে।”
অভুক্ত ১৫০টি ঘোড়া
সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার ১৫০টি ঘোড়া রয়েছে অভুক্ত। এই প্রাণীগুলো মূলত ওই এলাকার ঐতিহ্যবাহী বাহন “ঘোড়ার গাড়” টানে। কিন্তু তাদের মালিকদের সেই জীবিকার পথ এখন বন্ধ।
ঘোড়ার গাড়ির মালিক নিজাম উদ্দিন বলেন, “আমাদের এখন কোনো রোজগার নেই। তবুও প্রতিদিন ঘোড়াগুলোকে খাওয়াতে হয়।”
তার আস্তাবলে থাকে ৭টি ঘোড়া। প্রত্যেকটির জন্য দিনে অন্তত ৩৫০ টাকার খাবার দিতে হয়।
প্রসঙ্গত, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট আইনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে দুর্যোগের সময়ে পথপ্রাণীদের খাদ্য সরবরাহে সেখানে কোনো বিধান রাখা হয়নি।
মতামত দিন