দুটি প্রতিষ্ঠানেরই ব্যবসায়িক মডেল একই হওয়ায় তাদের পরিণতিও একই রকম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে
বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির মতোই আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডে। ইনভ্যারিয়েন্টের দাবি, এখনও ধামাকার কাছে ২০০ কোটি টাকা পাবে তারা।
বছরব্যাপী বিশাল ছাড় এবং ১৫০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে ইভ্যালি সারা দেশে বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। ইভ্যালির ক্যাম্পেইনগুলোর মতো ৪০-৫০% পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্কের মূল্যছাড়ের মাধ্যমে ধামাকা শপিংও গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ সংগ্রহ করেছিল বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন- বৈধ লাইসেন্স নেই ধামাকা শপিংয়ের, অর্থ পাচারের অভিযোগ
অর্থ ফেরত না দেওয়া এবং ডেলিভারি নিয়ে অভিযোগ-অনিয়মের কারণে ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জের মতো বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির সিইও রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, প্রতিষ্ঠানটির এক হাজার কোটি টাকারও বেশি দেনা রয়েছে।
এ নিয়ে ধামাকা শপিংয়ের বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
আরও পড়ুন- ‘ধামাকার’ ১১৭ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ সিআইডির হাতে
তারা জানায়, অর্ডারকৃত পণ্যের ডেলিভারি প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দাম বুঝিয়ে দেওয়ার চুক্তির পর ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে অনেক ব্যবসায়ীই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটিকে পণ্য সরবরাহ করে আসছিল। তবে ১৬০ দিন পেরিয়ে গেলেও অনেক বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ী তাদের অর্থ বা পণ্য বুঝে পাননি।
ধামাকা শপিং ডটকম সেলার অ্যসোসিয়েশন জানায়, ৬৫০ জন ব্যবসায়ীর কাছে ধামাকার ২০০ কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে। এছাড়াও, ১০০ কোটি টাকা মূল্যমানের ১ লাখ ডেলিভারি দিতে পারেনি তারা।
সংগঠনটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানান, ধামাকা শপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দিন চিশতী বারবার অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
আরও পড়ুন- র্যাব: গ্রাহক-মার্চেন্টদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না ইভ্যালির
তিনি বলেন, “দায়মুক্তির চেষ্টায় থাকা ধামাকা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বারবার আলোচনা সত্ত্বেও তারা কোনো মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে না এবং কোনো সমাধানও দিচ্ছে না।”
আগামী ৫ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কোনো সমাধান না এলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।
বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছেন বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীরা।
এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে পাঠানো এক চিঠিতে সরবরাহকারীরা ধামাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার মুলতবি পেমেন্ট পুনরুদ্ধারে সহায়তা চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান তারা।
আরও পড়ুন- র্যাব: জেনে-শুনেই ব্যবসায়িক ‘অপকৌশল’ গ্রহণ করেন রাসেল
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই মাসের শুরুর দিকে ধামাকা শপিংয়ের মালিকদের বিরুদ্ধে প্রায় ১১৭ কোটি টাকা পাচারের জন্য মামলা করেছিল। সিআইডির তদন্তে উঠে আসে, ধামাকা শপিং গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম পেমেন্ট হিসেবে পাওয়া ৫০ কোটি টাকারও বেশি কর্মকর্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছে এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছে। উপরন্তু, প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৫৮৮ কোটি টাকার লেনদেনের ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি।
অর্থপাচারের অভিযোগে ধামাকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন চিশতীর ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের ১৪টি ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশও ওই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির এক কর্মকর্তা জুলাই মাসে ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “প্ল্যাটফর্মটি নিবন্ধিত নয় এবং এটির বৈধ লাইসেন্সও নেই।”
আরও পড়ুন- ই-কমার্সের প্রতারণা থেকে গ্রাহকদের বাঁচাতে প্রচারণা চালানোর পরামর্শ আদালতের
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ধামাকা বিভিন্ন লাভজনক অফারের মাধ্যমে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি অর্ডার গ্রহণ করে। সিআইডি সূত্রানুযায়ী, “ডাবল টাকা ভাউচার”, “সিগনেচার কার্ড” এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক মোটা অংকের ডিসকাউন্টের মতো লোভনীয় অফার দিয়ে হাজার হাজার গ্রাহককে প্রতারিত করেছে ধামাকা।
জাতীয় ভোক্তা সুরক্ষা অধিদপ্তর বেশ কয়েকজন ভোক্তার কাছ থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, তাদের পণ্য সরবরাহের হার ২০% এরও কম।
ধামাকা গত বছরের নভেম্বরে ব্যবসা শুরু করলেও তাদের নিজস্ব কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। পরিবর্তে বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।
ইভালির মতো তারাও ৫০% পর্যন্ত মূল্যছাড় দিয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়।
আরও পড়ুন- ‘ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা’
তারেক নামে (ছদ্মনাম) ধামাকার এক ভোক্তা ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, ইভ্যালিতে কয়েক হাজার টাকার মূল্যের পণ্য অর্ডার করার পর তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। পরে ধামাকাতে অর্ডারের পর শুরুর দিকে তার অর্ডারের পণ্যগুলোর ডেলিভারি সঠিকভাবে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে প্ল্যাটফর্মটি ২০ হাজার টাকার অর্ডারের ডেলিভারি দেয়নি।
তবে এ বিষয়ে কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি অভিযোগ করেননি। কারণ তার ধারণা, তিনি কোনোভাবেই টাকা ফেরত পাবেন না।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশে এসব প্ল্যাটফর্মের এ ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রতারণামূলক।
তিনি বলেন, “যদি আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন ব্যবসায় তাদের নতুন বিনিয়োগের মূলধন কী, তাহলে তারা বলবে এটা শূন্য। এই ই-কমার্স আউটলেটগুলো তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য গ্রাহকদেরর অর্থ ব্যবহার করেছিল। অফার ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তাদের পক্ষে টেকসই ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়।”
আরও পড়ুন- পুলিশ: জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক কথা বলেছেন রাসেল-শামীমা
ধামাকাকেও ইভ্যালির মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, এই কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক মডেল একই, তাই তারা যদি একই ভাগ্য বরণ করে তাহলে তা অবাক করার মতো কোনো বিষয় হবে না।
তিনি বলেন, “এই দুটি কোম্পানিই ভোক্তার অর্থ ব্যবহার করে একই মডেলের ওপর ভিত্তি করে বড় অঙ্কের দায় বহন করে। তাদের ব্যবসায়ে নতুন বিনিয়োগের মূলধন নেই এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেনা দ্রুত বেড়েছে।”
যদি পুনরায় ব্যবসাগুলো পরিচালনার অনুমতি না দেওয়া হয় তাহলে অনেকগুলো দায় পুনরুদ্ধারযোগ্য নাও হতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
এ বিষয়ে চেষ্টা করেও ঢাকা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে ধামাকা সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা ট্রিবিউনের ডিএস সৌরভও এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন।
মতামত দিন