উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক সোহেল রানা ২০ শতক জমিতে গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ করে খরচ বাদে তিন মাসে দুই লাখ টাকা আয় করেছেন
রাজশাহীতে প্রতিদিনই বাড়ছে ফুলের কদর। সেইসাথে বাজারে দামও বাড়ছে। সে জন্য ফুলের ভাল দাম পাচ্ছেন ফুল চাষিরা। তারা লাভবান হচ্ছেন। এ কারণে দিন দিন রাজশাহীতে ফুল চাষ বাড়ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, স্থানীয় বাজারে ফুলের যে চাহিদা রয়েছে তার শতভাগ এখনও রাজশাহীতে উৎপাদন হয় না। আরও অন্তত ১০০ বিঘা জমিতে ফুল চাষ হলে চাহিদা মিটবে।
জানা গেছে, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার হামিদকুড়া গ্রামের সোহেল রানা শখের বসে বাড়ির পাশের পতিত তিন শতক জমিতে গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ করেন। প্রথমবার ফুল চাষ করেই লাভবান হয়েছেন তিনি। মাত্র তিন হাজার টাকা খরচ করে তার সেই জমিতে ফুল বিক্রি করেছেন আট হাজার টাকার। ফুল চাষে সাফল্য দেখে উৎসাহ বাড়তে থাকে তার।
উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক সোহেল রানা ২০ শতক জমিতে গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ করে খরচ বাদে তিন মাসে দুই লাখ টাকা আয় করেছেন।
সাবেক বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা বেগমের পরামর্শে বাড়ির পাশে ২০১৪ সালে আট শতক জমিতে গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ শুরু করেন সোহেল রানা। প্রথমবার তিন হাজার টাকা খরচ করে আট হাজার টাকার ফুল বিক্রি করে। ২০১৬ সালে ১২ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে ১৫ হাজার টাকা, ২০১৮ সালে ১৮ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৩০ হাজার টাকা, ২০২০ সালে ৫০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে এই বছর ইতোমধ্যেই ৪০ হাজার টাকা ফুল বিক্রি করা হয়েছে।
উপজেলায় বাণিজ্যিক কভাবে গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ এই প্রথম। সোহেল রানার আট শতক জমিতে সাদা, হলুদ ও গোলাপি রঙের গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ করছেন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে এ ফুলের চারা রোপণ করতে হয়। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ফলন পাওয়া যায়।
বর্তমান বাজারে প্রতিটি গ্ল্যাডিওলাস ফুলের স্টিক ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং প্রতিটি গ্ল্যাডিওলাস ফুলের স্টিক ফুল ব্যবসায়ীদের কাছে ৭ থেকে ৮ টাকায় বিক্রি করেন।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার হামিদকুড়া গ্রামের সোহেল রানা জানান, "আমি ২০১৬ সালে ইসলামের ইতিহাস থেকে রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে বেকার ঘুরে বেড়াতাম। ফুল চাষ করে বাড়তি আয় করা যায়, সেই চিন্তা থেকে বাঘা উপজেলার তৎকালিন কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা বেগমের পরামর্শে যশোরের এক বন্ধুর সহযোগিতায় ঝিকরগাছা থেকে বীজ সংগ্রহ করে ৮ শতক জমিতে গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ করেছি। অধিক দামে সার ও ডিজেল কিনে অন্য ফসলের উৎপাদন খরচই ওঠে না। বাড়তি আয়ের জন্য গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষ করি। ইতোমধ্যেই ৪০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেছি। জমিতে আরও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ফুল রয়েছে। তবে এই ফুল বিক্রি করতে কোন সমস্যা হয় না। ব্যবসায়ীরা প্রতিমাসে দুই থেকে তিনবার ফোন দেয়। ফুল বিক্রি করার মতো হলে রাজশাহী, নাটোর, ঈশ্বরদীর ব্যবসায়ীদের জানালে তারা জমি থেকে নিয়ে যায়। তারা ন্যায্য দামও দেন।"
বাঘা উপজেলা সহকারি কৃষি কর্মকর্তা দিলিপ কুমার সরকার বলেন, ফুল বিক্রির পর চাষিরা বীজও বিক্রি করতে পারবেন। আট শতক জমি থেকে অন্তত ৩০ হাজার টাকার চারা বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তবে সোহেলা রানা অনেকটাই ফুল চাষ করে সফলতা পেয়েছেন।
ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর ফুল চাষের পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ফুলের চাহিদা বেড়ে যায়। দামও তুলনামূলক বেশি থাকে। শুধু সোহেরই নয় ফুল চাষে ভাগ্য ফিরছে জেলার অন্য চাষিদেরও। আর তাই দিন দিন আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা।
রাজশাহীর জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় নানা প্রজাতির ফুল চাষ হচ্ছে। আর সে ফুল রাজশাহী নগরী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে অন্য জেলা থেকে ফুল আমদানির চাহিদা তুলানামূলকভাবে কমে গেছে। চলতি মৌসুমে গোদাগাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় গ্লাডিওলাস, গাদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ও জারবেরাসহ বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের গোপালপুর ও মোহনপুর ইউনিয়নের বাউটিয়া এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হয়ে আসছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় প্রতিবছরই বাড়ছে ফুল চাষ। প্রতিবছর ফুল চাষে লাভবান হওয়ার কারণে দিন দিন আগ্রহ দেখাচ্ছেন চাষিরা। বর্তমানে জেলায় মোট ৫০ বিঘা জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। গোদাগাড়ী, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় বাণিজিক ভাবে চাষ হচ্ছে। এসব এলাকায় মূলত গাঁদা, গ্ল্যাডিওলাস ও জারবেরা চাষ হয়।
কৃষিবিদ শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, "পরীক্ষামূলক গ্ল্যাডিওলাস চাষে সাফল্য পাওয়া গেছে। কৃষকদের ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের বীজ দিয়ে সহায়তা দেওয়া হবে। ফুল বিক্রির পর কৃষকেরা বীজও বিক্রি করতে পারবেন। তিন শতক জমি থেকে অন্তত ১০ হাজার টাকার চারা বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। অল্প জমিতে স্বল্প সময়ে এই ফুল চাষ করে অধিক উপার্জন করা সম্ভব।"
গোদাগাড়ীর কৃষক নাদিম হোসেন চার বিঘা জমিতে জারবেরা, গাদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ও গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করেছে। তিনি বলেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে খুচরা ফুল বিক্রেতারা জমিতে এসে তাদের পছন্দ অনুযায়ী ফুল কিনে নিয়ে যান। তিনি লাভবান হচ্ছেন।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সদ্য বদলি হওয়া উপপরিচালক শামসুল হক বলেন, "রাজশাহীতে দিন দিন ফুল চাষ বাড়ছে। তবে ব্যাপক হারে হচ্ছে না। অল্প অল্প করে চাষ করছেন তারা। রাজশাহীতে অনেক চাষি নতুন। কিছু সমস্যা আছে। তারা সার দেওয়া, চারা কোথায় পাওয়া যাবে এসব পরামর্শ দেওয়া হয় কৃষি বিভাগ থেকে।"
তিনি আরও বলেন, "রাজশাহীতে অনেক চাহিদা আছে। এটি মূলত বাণিজ্যিক আকারে গড়ে উঠবে। রাজশাহীতে যে পরিমাণ ফুল লাগে তাতে দেড়শো হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করতে হবে। রাজশাহীর মাটিতে এটি সম্ভব। এগুলো চাষে অনেকেই সফল হচ্ছেন। কারণ এটি অনেক লাভজনক চাষ।"
মতামত দিন