১৮ হাজারেরও বেশি সহিংসতার ঘটনায় ২৬ হাজার ৩৫২ জনের মধ্যে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে
২০ বছর আগে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন পূর্ণিমা রাণী। নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছিল তাকে। প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু পূর্ণিমা হাল ছাড়েননি। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে গঠন করেন “পূর্ণিমা ফাউন্ডেশন” নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি শত শত ধর্ষিতা নারী এবং তাদের পরিবারকে সহায়তা করে চলেছেন। তিনি ধর্ষণের শিকার নারীদের বেঁচে থাকতে ও জীবন সংগ্রামে লড়াই করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।
এ ঘটনার পর ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম পূর্ণিমাকে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালে প্রতিমন্ত্রী পদ ছাড়ার পর সরকার তার চাকরি নিয়মিত করেনি।
পূর্ণিমা কোভিড -১৯ মহামারিকালে “পূর্ণিমা ফাউন্ডেশনের” আওতায় শত শত নারী ও শিশুদের নগদ অর্থ এবং খাদ্য সহায়তা দিতে বিভিন্নভাবে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। জীবনের বাঁকে এসে ৩৩ বছর বয়সী পূর্ণিমা এখন বেকার। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। চালিয়ে যাচ্ছেন সংগ্রাম। ফাউন্ডেশনের জন্য কাজ করা ছাড়াও, পূর্ণিমা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা এবং শিক্ষায় সময় ব্যয় করছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন।
বর্তমান সমাজে ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিশেষ করে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তিনি মানবিক কার্যক্রম আরও প্রসারিত করতে চান। তিনি মনে করেন, ধর্ষণ থেকে বেঁচে যাওয়া নারী এবং বিভিন্ন সহিংসতার শিকার শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার প্রয়োজন।
পূর্ণিমা রাণী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “যখন আমি নির্যাতিতদের সঙ্গে কাজ করি তখন আমার সেই রাতের কথা মনে পড়ে যায়। আমি ভুলতে পারি না। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার জন্য আমাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। আমি বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের তাদের জীবনকে ভালোবাসতে এবং ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। কারণ তাদের ওপর নির্যাতনের জন্য তাদেরকে দায়ী করা যাবে না। বরং সমাজের উচিত ধর্ষকদের শাস্তি দেওয়া এবং তাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করা।”
এ সময় তিনি নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীদের বিচারের বিলম্বের নিন্দা জানান।
তিনি জানান, ওই ঘটনায় জড়িত কিছু আসামি জামিনে কারাগারের বাইরে। এটা তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক।
পূর্ণিমা বলেন, “এ ধরনের ঘটনা রোধে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং আদালতে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা জরুরি। পাশাপাশি ভুক্তভোগী যিনি বেঁচে থাকেন তার এবং তার পরিবারকে আবারও যাতে হয়রানি হতে না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করবে এবং সরকার ও জাতির ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। যে জাতি নারীদের সম্মান করতে না পারে, তাহলে সে জাতি বেশিদূর এগোতে পারে না।”
পূর্ণিমাকে গণধর্ষণের দায়ে আদালত ১১ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পর ১০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত এখনও দোষীদের দায়ের করা আপিল নিষ্পত্তি করতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের উচিত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা
সংখ্যালঘু অধিকার নেতা রানা দাশগুপ্ত বহুল আলোচিত এ মামলায় বিচার বিলম্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
তিনি মনে করেন, হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর রাজনৈতিক হামলা রোধ করা যেত, যদি আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অপরাধীদের বিচার করে এবং রায় কার্যকর করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করত।
এক সংবাদ সম্মেলনে রানা দাশগুপ্ত সরকারকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হত্যা, ভয়ভীতি, হামলা ও সহিংসতার ঘটনা বন্ধ করতে এবং তাদের মানবাধিকার, নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক এবং এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চ এই আদেশ দিয়েছিলেন। একই বেঞ্চে গত ১৫ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সংখ্যালঘু এবং সারাদেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
হাইকোর্টের ওই আদেশের পর ২০০৯ সালে সাবেক জেলা জজ মো. শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করে।
এতে ১৮ হাজারেরও বেশি সহিংসতার ঘটনায় ২৬ হাজার ৩৫২ জনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
মতামত দিন