এ ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলা একসঙ্গে পরিচালনা করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
সিলেট এমসি কলেজে চাঞ্চল্যকর নববধূ গণধর্ষণ মামলার এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোভিড মহামারিসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি বিচারাধীন থাকলেও এ ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলা একসঙ্গে পরিচালনা করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
আগামী ১৩ অক্টোবর মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা রয়েছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান অ্যাডভোকেট শহিদুজ্জামান চৌধুরী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “কয়েক মাস আগে মামলা দু’টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তোলার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। এ বিষয়ে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী গণধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনের দু’টি মামলার বিচার হবে একসঙ্গে এবং একই আদালতে। এজন্য নতুন করে অভিযোগ গঠন করতে হবে।”
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট রাশিদা সাঈদা খানম বলেন, “উচ্চ আদালতের আদেশের ফলে এ মামলার নতুন করে অভিযোগ গঠন করতে হবে। তবে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দু’টি পাঠানোর বিষয়ে জানা নেই।”
সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের একটি সূত্র জানায়, কোভিড মহামারিসহ এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলা একসঙ্গে চালানোর ইস্যুতে মামলার বিচার কার্যক্রম কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে।
অভিযোগ গঠন করা হবে আবারও
গত ২৪ জানুয়ারি আদালতে এই দু’টি মামলার বিচার কাজ একসঙ্গে শুরু করার আবেদন করেছিলেন বাদীপক্ষ। শুনানি শেষে বিচারক আবেদনটি খারিজ করে দেন। এরপর বাদীপক্ষ মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম একই আদালতে সম্পন্নের জন্য জানুয়ারি মাসেই উচ্চ আদালতে একটি ফৌজদারি মামলা করেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ মামলার শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে একই আদালতে সম্পন্নের আদেশ দেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কোনো মামলায় একসাথে দণ্ডবিধি আইনের ধারা থাকলে মামলার বিচার একই আদালতে চলতে পারে। একসঙ্গে বিচার কার্যক্রম চলতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু একই ঘটনায় পুলিশের দু’টি অভিযোগপত্র দেওয়ায় বাদীপক্ষের সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এতে ন্যায় বিচার ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সাক্ষীদের জন্যও বিষয়টি বিড়ম্বনার।
কারণ, চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাক্ষীরা দুই আদালতে দুই দিন আসবেন কি-না এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বাদীপক্ষ। ধর্ষণকারীরা সকলেই নানাভাবে প্রভাবশালী। এজন্য বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন।
অভিযোগপত্রে রয়েছে যাদের নাম
আলোচিত এই গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ এলাকার আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭) অভিযুক্ত করে দণ্ডবিধির ৩৪২/৩২৩/৩৭৯/৩৮৫/৩৪ ধারাসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০(সংশোধনী, ২০০৩) এর /৭/৯/(৩)৩০ ধারায় গত বছরের ৩ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পুলিশ। এতে ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য রাজন ঘটনার ২ মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেন। গ্রেপ্তার এই ৮ আসামির সবাই অকপটে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
আট আসামির মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক ও অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নববধূকে গণধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে।
আসামিদের সবাই স্থানীয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিল। তারা “টিলগড়” গ্রুপে সক্রিয় ছিল বলেও সূত্র জানিয়েছে। বর্তমানে ৮ আসামিই সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে।
অভিযোগপত্রের শুনানি
এ বছরের ৩ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ করা নিয়ে প্রথম শুনানি হয়। ওই দিন বাদীপক্ষ অভিযোগপত্র পর্যালোচনায় সময় প্রার্থনা করেন। ১০ জানুয়ারি বাদীপক্ষের আইনজীবী অভিযোগপত্র পর্যালোচনার জন্য আবেদন করে সময় চাইলে আদালত দুই দিনের সময় নির্ধারণ করে দেন। বাদীপক্ষের আবেদনে অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করার জন্য আদালতে জমা দেওয়া বেশ কিছু নথি চাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল মামলার অভিযোগপত্র, সিজার লিস্ট, জিম্মা নামা, স্কেচ, ইনডেক্স, ইনডেক্সের সূচি ও ব্যাখ্যা, মেডিকেল ও ডিএনএ রিপোর্ট, আসামীদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ২২ ধারার জবানবন্দি, আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ও আসামিদের রিমান্ড আবেদনের কপি।
এদিকে, গণধর্ষণের ঘটনার আগে অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। ঘটনার ১ মাস ২৭ দিন পর ২২ নভেম্বর অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়া হয়। ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিসহ ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত সকলকে আসামি করে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯/১৯এ ধারায় অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়া হয়।
ধর্ষণ করেছিল ৬ জন
এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার পর গত বছরের ১ ও ৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আদালতের আদেশের পর ওসমানী মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার বা ওসিসির মাধ্যমে ৮ আসামির ডিএনএ সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। নমুনা সংগ্রহের প্রায় ২ মাস পর ৩০ নভেম্বর আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ডিএনএ রিপোর্ট আসে।
ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ “ম্যাচিং” পাওয়া যায়। এদিকে আইনুদ্দিন ও মিসবাহ উদ্দিন রাজনের ডিএনএ “মিক্সিং” পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার ফলে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ৬ জনই গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছিল।
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের শিকার হন স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া এক গৃহবধূ। এরপর পুলিশ ধর্ষণের শিকার ওই নারীকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে ওসিসিতে তিনদিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি। ওই রাতেই ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে মহানগরের শাহপরান থানায় ছয় ছাত্রলীগকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মতামত দিন