কোভিডকালে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিরাপত্তার কারণেই বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি বেশিরভাগ অভিভাবকের
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্কুল বন্ধের দেড় বছরে খুলনা জেলার মাধ্যমিক স্কুলের ৩,০০৯ জন ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। ৭ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীরা শিকার হন এ বাল্য বিয়ের। খুলনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন ঢাকা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া ছাত্রীরা কম-বেশি স্কুলে আসা যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। তবে সকলেই যাতে স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত থাকে বা থাকতে পারে সে বিষয়ে স্কুল থেকে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে।”
খুলনা জেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারির দেড় বছরে ডুমুরিয়া উপজেলায় ৭৫১টি, কয়রা উপজেলায় ৬৮১টি, পাইকগাছা উপজেলায় ৪৮৩টি, দাকোপ উপজেলায় ২৯১টি, রূপসা উপজেলায় ২১৭টি, খুলনা মহানগরীতে ১৫৮টি, তেরখাদা উপজেলায় ১৪৯টি, ফুলতলা উপজেলায় ২৪০টি,বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৩৩টি ও দিঘলিয়া উপজেলায় ৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৭০টি, কয়রা উপজেলার কালনা মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় ৫২টি, মদিনাবাদ মহিলা মাদ্রাসায় ৫০টি, ডুমুরিয়া উপজেলার মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় ৩৮ জন, তেরখাদা উপজেলার কুশলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৭টি, খুলনা মহানগরীর হ্যানে রেলওয়ে গার্লস স্কুলে ১৭টি বাল্যবিয়ে হয়েছে।
খুলনা মহানগরীর গিলাতলা হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর ৩ মাস আগে বিয়ে হয়। পড়াশোনার আগ্রহ থাকার পরও পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে তাকে।
তিনি জানান, করোনাভাইরাসে স্কুল বন্ধ, পরিবারে চলছে অভাব-অনটন, এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা তার বিয়ে ঠিক করে। কাবিন হয়েছে, তাই বাবার বাড়িতে থেকে সে এখনও স্কুলে যেতে পারছে। তবে আগামী ডিসেম্বরে তাকে তুলে নেওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায় সে।
ওই শিক্ষার্থীর মা জানান, বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ- এটা তিনি জানেন। কিন্তু অসহায়। অভাব অনটনের মধ্যে কর্মজীবী ভালো ছেলে পেয়ে তারা হাতছাড়া করতে চাননি। লকডাউনের মধ্যে স্বামীর আয় নেই, কাজ নেই, স্কুল বন্ধ, মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না- এলাকার পরিবেশ ভালো না। মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে ভেবেই বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
লবন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত এক নারী জানান, গত শনিবারই তার মেয়েকে (১৪) বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণে ৫ ক্লাস পড়ার পর আর স্কুলে যেতে পারেনি। খালার বাসায় থাকত। তিনি কোম্পানির পরিত্যক্ত জমিতে ঘর তুলে বাস করছেন। আর্থিক সঙ্কট ও নিরাপত্তার কারণেই আগেভাগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনিও ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। ৭ বছর আগে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
আটরা শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহসেন বিশ্বাস বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারিকালে স্কুল বন্ধ থাকায় এ স্কুলের ১২ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। দেড় বছরের অধিক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক হলেও অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের পরিবারের মেয়েরাই বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে।”
এছাড়া স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, গিলাতলায় ইতোপূর্বে নিম্নবিত্ত পরিবারে বাল্যবিয়ের ঘটনা বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, গিলাতলা ও আশপাশের প্রতিটি বিদ্যালয় থেকেই সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কমপক্ষে গড়ে ২০ জন করে শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। বিবাহিত শিক্ষার্থীর মধ্যে দু-একজন শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই একই চিত্র।
পরিচয় গোপন করার শর্তে কিছু অভিভাবক বলেন, “কোভিডকালে স্কুল বন্ধের সময় তাদের মেয়েদের নিরাপত্তার কারণেই তারা বাল্যবিবাহ দিয়েছেন।”
মতামত দিন