সম্প্রতি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া এই ‘মরা তিস্তা’ আর ‘ঘিরনই নদী’ খনন করা হয়েছে
২০০ বছর আগে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা আর ঘিরাই নদীর দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার এলাকা দখল মুক্ত করা হয়েছে। নদী বলতে এলাকার মানুষ শুধু গল্পই শুনেছে। বাবা দাদারা গল্প করেছে-অনেক অনেক বছর আগে দুটি নদী ছিল। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে।
সম্প্রতি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া এই “মরা তিস্তা” আর “ঘিরনই নদী” খনন করা হয়েছে।
বরেন্দ্র বহুমুখি কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা আর ঘিরনই নদী নদী উদ্ধার করে খনন করেছে। ফলেও আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া দুই নদী। দীর্ঘ ২০০ বছর পর সেই নদীতে এখন নৌকা চলছে, জেলেরা মাছ ধরছে নদীতে।
বরেন্দ্র বহুমুখি কর্তৃপক্ষ বলছে, শুধু নদী খনন নয়, দুই পাড় সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।
উদ্ধার হওয়া মরা তিস্তা আর ঘিরনই নদী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকলী ও যমুনেশ্বরী নদীর মূলধারা। চলতি বর্ষা মৌসুমে পানি থৈথৈ করছে পুরো নদীতে।
বরেন্দ্র বহুমুখি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা আদনান আসিফ ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১৭৭৬ সালের রেনেল মানচিত্রে প্রদর্শিত তিস্তা নদীর একটি শাখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলা অতিক্রম করে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শেষভাগে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। রেনেল মানচিত্রে এ নদীকে তিস্তা নামেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদ আবু জাহেদ জানান, কাগজপত্র দেখে এবং নদ নদীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৭৮৭ সালে ভয়াবহ ভুমিকম্প ও বন্যা হয়েছিলো রংপুরসহ আশেপাশের এলাকা সহ ভারতের একাংশ এলাকা জুড়ে এর ফলে গতিপথ পরিবর্তন করে তিস্তা নদী। এর ফলে উত্তরাঞ্চলের নদ নদী গুলো তাদের স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। মরা তিস্তা নদীর এ শাখাটি মুল তিস্তা নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। যমুনেশ্বরী ও চিকলী নামে পরিচিতি পায় নদীগুলো। একইসঙ্গে হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদীর পুরোটাই বেদখল হয়ে যায়, গড়ে ওঠে বসতি। শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ শুরু করে এলাকার মানুষ। ফলে বন্ধ হতে থাকে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ।
আগে বন্যার সময় এটি চিকলী ও যমুনেশ্বরী নদীর প্রবাহ বজায় থাকলেও একসময় সে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধ ও বন্যাকবলিত হয়। নদী না থাকায় অনেক মৎস্যজীবী পেশা ফেলে অনেকেই ভিন্ন পেশা বেছে নেয়।
এমন পরিস্থিতিতে নিখোঁজ নদী উদ্ধার ও দখলমুক্তকরণে পরিকল্পনা শুরু করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তাদের উদ্যোগে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআরপি) মাধ্যমে খাল, ছোট নদী খনন কার্যক্রম শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে বদরগঞ্জের হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদীর প্রবাহ এলাকা শনাক্ত করে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈঘের এ নদীটি খনন করা হয়। এতে করে কালের বিবর্তনে লিুপ্ত হয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদী প্রায় দুইশ বছর পর প্রান ফিরে পায়।
এ ব্যাপারে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান জানান, দীর্ঘ দিন সংস্কারের অভাবে নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। গোচারণভূমি হয়ে গেছে। অনেকেই চাষাবাদ করত। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো, বন্যা হতো, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতো। জলাবদ্ধ থাকা জমিগুলো এখন চাষের উপযোগী হয়ে উঠছে। এখন মরা তিস্তা আবার তার হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে। । সেখানে প্রায় ২০টি গ্রামের ৫ হাজার হেক্টর জলাবদ্ধ জমি এখন চাষ উপযোগী হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “নদী এবং বিল খননের ফলে এলাকাবাসীর দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক এখন বাড়তি সুবিধা পাবেন। স্থানীয়রা নদী উদ্ধারের সুফল ভোগ করতে পারছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নদীর দুধারে গাছ লাগানো হচ্ছে। চলমান এই কার্যক্রম প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এলাকার বিনোদনের জায়গা হিসেবে বিলটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে “
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, “মরা তিস্তা ছিল অস্তিত্বহীন নিখোঁজ নদী। আমরা মানচিত্র ধরে মাঠ পর্যায়ে এ নদীর সন্ধান করেছি। নদীর বিভিন্ন অংশ মানুষের দখলে ছিল। অনেকেই এ নদীকে কাগজে কলমে বাপ-দাদার সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে নদী খনন ও উদ্ধার প্রক্রিয়া আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা এলাকাবাসীর সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। তাদের নদীর গুরুত্ব ও প্রভাব বোঝাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। তারা স্বেচ্ছায় নদীর জমি ছেড়ে দিয়েছেন। পরে প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় নদী খনন করা হয়েছে। এখন সেখানকার মানুষরা মরা তিস্তার জেগে উঠার সুবিধা যুগ যুগ ধরে ভোগ করতে পারবেন।”
বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে হারিয়ে যাওয়া ঘিরনই নদীটি করতোয়া নামে রংপুর-দিনাজপুর সীমানা বরাবর ৩৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বদরগঞ্জের বকসীগঞ্জ ব্রিজের উজানে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা থেকে প্রবাহিত হয়ে সোনারবান (সোনারবন্ধ) নামে অপর একটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত প্রবাহ “ঘিরনই” নামে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুর ও লোহানীপাড়া ইউনিয়নের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর ইউনিয়নে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ঘিরনই নদীর দৈর্ঘ্য ৪৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে চলতি বছর (২০২০-২০২১) এই নদীর ৩ দশমিক ২৬৫ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়েছে। ফলে খনন করা অংশের দুপাড়ের চারটি গ্রামের জনগণের দৈনন্দিন গৃহস্থলি কাজে নদীর পানি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, এই অঞ্চলের কৃষি, জীব বৈচিত্র এবং পরিবেশের একটি অভাবনীয় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে মরা তিস্তা নদী খনন করার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, “দেশের প্রত্যেক এলাকার নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।” একইসঙ্গে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করার দাবি জানান তিনি।
মতামত দিন