সাম্প্রতিক এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অপরিকল্পিত রাস্তা এবং নির্মাণকাজ ৩০% বায়ু দূষণের জন্য দায়ী
সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডির (সিএপিএস) এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণেই ঢাকার ১৫% বায়ু দূষণ হয়।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, রাজধানীতে অপরিকল্পিত এবং অনিয়ন্ত্রিত রাস্তাখনন এবং নির্মাণকাজের কারণে ৩০% বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।
বায়ু দূষণের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে ইটের ভাটা এবং কারখানা (২৯%), যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া (১৫%), সীমান্তবর্তী বায়ু দূষণ (১০%), গৃহস্থালি এবং রান্নার চুলা (৯%) এবং বর্জ্য পোড়ানো (৭%)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৩ সালে কালো ধোঁয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। এরপর গত দুই বছরে যানবানহন থেকে নির্গত ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের মতে, বায়ু দূষণকারী কালো ধোঁয়া নির্গমনের পিছনে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, কেবল ফিটনেসবিহীন যানবাহনই না, ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে এমন অনেক যানবাহন থেকেও কালো ধোঁয়া নির্গত হয়।
যানবাহনে আটকে থাকা তরল পেট্রোলিয়াম পোড়ানোর পর যানবাহন থেকে যে পদার্থ নির্গত হয়, সেটিও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
২০১৯ সালে সর্বশেষ সরকারি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় ১৬ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে, মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসের গাড়ির সংখ্যা ৫ লাখ। প্রতি বছরেই মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসের গাড়ির সংখ্যা ২০%-৩০% হারে বাড়ছে।
গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ৯০% ক্ষেত্রেই ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। এ পদ্ধতিতে সাধারণত প্রতিটি গাড়ির পরীক্ষায় জন্য এক থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগে।
এদিকে, বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে যানবাহন পরিদর্শন কেন্দ্র (ভিআইসি) নির্গমন পরীক্ষা মেশিনের মাধ্যমে ডিজিটাল উপায়ে গাড়ির কালো ধোঁয়া পরীক্ষা করার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
বিআরটিএ কর্মকর্তাদের মতে, এই ধরনের দুটি মেশিন রয়েছে বলে ফিটনেস পরীক্ষা বেশিরভাগ সময় ম্যানুয়ালি পরিচালিত হয়।
বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ফিটনেস সিলেকশন) মোরশেদুল আলম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ডিজেলচালিত ভারী যানবাহন থেকেই সাধারণত কালো ধোঁয়া নির্গত হয়।”
তিনি বলেন, যখন ইঞ্জিনের তেল সময়মতো পরিবর্তন করা হয় না এবং ইঞ্জিন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, তখনই সমস্যা হয়।
মোরশেদুল জানান, ম্যানুয়াল পরীক্ষার সময় কী পরিমাণ কালো ধোঁয়া নির্গত হয় তা পরিদর্শক এবং বিশেষজ্ঞরা হাতে-কলমে চিহ্নিত করেন।
তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিন মাত্র ৩২টি যানবাহন পরীক্ষা করা হয় কারণ প্রতিটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগে।
তিনি বলেন, “যেসব যানবাহন আমাদের কাছে ফিটনেসের জন্য আসে না, পুলিশ সেগুলোকে জরিমানা করে।”
মোরশেদুল আরও বলেন, “তিন মাস ধরে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। সুতরাং, কিছু ক্ষেত্রে যদি তাদের ফিটনেসের সনদপত্র থেকেও থাকে আসলে সেগুলো ফিটনেসবিহীন।”
এই সপ্তাহের শুরুতে বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে ফিটনেসের জন্য কর্তৃপক্ষ একটি মাত্র যানবাহন পরীক্ষা করছে। আরেকটি গাড়ি সারিতে অপেক্ষায় থাকলেও সার্ভারটি ক্র্যাশ হয়ে যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, যেসব যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়, তাদের শাস্তি দিতে তারা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে।
অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, “এছাড়াও,বায়ু দূষণের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য আমাদের কিছু প্রকল্প চলমান।”
তিনি আরও বলেন, “কিন্তু যানবাহন এবং অন্যান্য উৎস থেকে কালো ধোঁয়ার নির্গমন কমাতে আমাদের একটি বড় প্রকল্প দরকার। বিআরটিএর মতো অন্যান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে আমরা সেটিরই পরিকল্পনা করছি।”
সিএপিএসের সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকার বাতাসে ক্রোমিয়াম, পারদ, সীসা, তামা, নিকেল এবং রূপার মতো ক্ষতিকারক পদার্থগুলোর ক্ষুদ্র কণার পরিমাণ প্রায় ৮০%, যা হৃদরোগসহ অন্যান্য ফুসফুসবাহিত রোগের অন্যতম কারণ।
বায়ু দূষণের দিক থেকে ঢাকা বরাবরই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরগুলোর তালিকায় ওপরের দিকে থাকে।
যখন বায়ু মানের সূচক (একিউআই)২০১ থেকে ৩০০ এর মাঝে থাকলে তা “ত্রুটিপূর্ণ” বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, এই সূচক যখন ৩০১ থেকে ৪০০ এর মাঝে থাকে তখন তাকে “বিপজ্জনক” বলে মনে করা হয়। কারণ তা শহরের বাসিন্দাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। আর এই সূচক যখন ৪০১ থেকে ৫০০ এর মাঝে থাকে তখন সেটিকে “গুরুতর” বলে গণ্য করা হয়।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাস অর্থাৎ ৯০ দিনের মধ্যে ঢাকার বায়ু ১২ দিনের জন্য “বিপজ্জনক”, ৫৮ দিনের জন্য “অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর”, ১৯ দিনের জন্য “অস্বাস্থ্যকর” এবং এক দিন “সংবেদনশীল ব্যক্তির জন্য অস্বাস্থ্যকর” ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধক পালমোনারি রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়।
মতামত দিন