ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর লম্বা সাধুবেশী দাঁড়ি তার। দেখে মনে হবে যেন সবেমাত্র ধ্যান ভেঙে হিমালয় ছেড়ে কোনো সিদ্ধপুরুষ এসেছেন
চোখের পলকে স্যাকারিন মিশিয়ে মাটিকে “মিষ্টি মাটি” বানিয়ে মানুষকে খাওয়ানো কিংবা ফুঁ দিয়েই কাগজে আগুন ধরানো, এসব নানা ভেলকি তার কাছে মামুলি ব্যাপার! বাচ্চু প্রধান নামে সত্তোরোর্ধ্ব এই ব্যক্তি নিজেকে “সাধু” হিসেবে দাবি করেন। মানুষকে বোকা বানিয়ে বিভিন্ন পন্থায় লুটে নেন সর্বস্ব।
গত ৬ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আন্ধারমানিক এলাকায় এমনই নানা ছলা-কলায় একই পরিবারের ছয় সদস্যকে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত “প্রসাদ” খাইয়ে অচেতন করে ফেলেন তিনি। এরপর রাতের আঁধারে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন লুটে নিয়ে পালিয়ে যান।
পরদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলেও পরিবারটির কোনো সারাশব্দ না পেয়ে প্রতিবেশীরা খবর দেন স্থানীয় কাউন্সিলর আবু মোহাম্মদ নাহিদকে। তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে ওই ছয়জনকে অচেতন ও মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করেন।
বিষয়টি জানানো হয় পুলিশকে।
খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ভাস্কর সাহা ও সদর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আকবর আলী খান মানিকগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যান।
এ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে পুলিশ একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পরিবারটির অভিভাবক পঙ্কজ কুমার মন্ডল সুস্থ হয়ে বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় জানতে পারেন কথিত ওই সাধু চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় অবস্থান করছেন।
শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) তাকে ধরতে মানিকগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) টুটুল উদ্দিন ও এসআই মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল মতলব দক্ষিণ থানায় অভিযান চালায়।
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করে অভিযুক্ত সাধুবাবার বেশধরা প্রতারক বাচ্চু প্রধান (৭৩)। তার বাড়ি মতলব দক্ষিণের নারায়ণপুর গ্রামে। ৭-৮ বছর ধরে এ ধরনের প্রতারণায় যুক্ত থাকার কথা পুলিশকে জানিয়েছে সে।
এসআই মনিরুজ্জামান পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে পানি থেকে পাকড়াও করেন। বাচ্চুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় লুট করা মোবাইল, স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ।
তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার বাচ্চু একইভাবে এর আগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে অচেতন করে সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। তাকে মানিকগঞ্জের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রবিবার তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ভাস্কর সাহা জানান, এভাবে কোনো ব্যক্তির ভোঁজবাজির লোভে পরে কিংবা সরল বিশ্বাসে প্রতারিত না হতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সবাইকে সচেতন থাকতে বলা হয়েছে। কারণ মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধের কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম মারা যাওয়ার নজিরও রয়েছে।
তিনি বলেন, ওই প্রতারক সুন্দর-সুশ্রী চেহারার, ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর লম্বা সাধুবেশী দাঁড়ি তার। তাকে দেখে মনে হবে যেন সবেমাত্র ধ্যান ভেঙে হিমালয় ছেড়ে কোনো সিদ্ধপুরুষ এসেছেন আপনার দ্বারে!
এমন অবয়বের কারণে তিনি সহজেই সন্দেহ এড়াতে সক্ষম। এছাড়া তার নানান কলাকৌশলে যেকোনো সাধারণ মানুষ সহজেই তার “অলৌকিক ক্ষমতা” সম্পর্কে বিশ্বাস করতেই পারেন।
এসবের মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন করে তিনি ভুক্তভোগীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে পূজা-অর্চনার ছলে আস্থা অর্জন করে। এভাবেই মানিকগঞ্জের পরিবারটির সবাইকে সুযোগমতো খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সব রোগমুক্তির “মহাপ্রসাদ” খাওয়ান তিনি। এরপর রাতের আঁধারে ওই পরিবারের সব স্বর্ণালংকার, টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে চম্পট দেন তিনি।
মতামত দিন