ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্য আইইউটি কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত ‘সূর্যাস্ত আইন’ চালু করেছে
গাজীপুরে অবস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কয়েকজন বিদেশি ছাত্রের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একাধিক নারী শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগীরা বলেন, আইইউটি কর্তৃপক্ষ তাদের অভিযোগ উপেক্ষা করে অভিযুক্ত বিদেশি ছাত্রদের কোনো ধরনের সাজা না দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
এ নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনের এ প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যাচের বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। একই সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। দুটি ব্যাচ ছাড়া বাকি ব্যাচের প্রায় সব ছাত্রী জানান, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
যে দুটি ব্যাচের কাছ থেকে এমন অভিযোগের কথা জানা যায়নি, কোভিড মহামারির কারণে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসেই আসেননি তারা।
আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংগঠন (ওআইসি) অর্থায়িত বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৮৬ সাল থেকে ঢাকার গাজীপুরে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ২০১৭ সালের আগে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শুধুমাত্র পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
এদিকে, ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষার জন্য আইইউটি কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত “সূর্যাস্ত আইন” চালু করেছে। এই নিয়মে মাগরিবের নামাজের পর নারী শিক্ষার্থীরা হলের বাইরে বের হতে পারবেন না।
কিন্তু ভুক্তভোগীরা মনে করেন, বিতর্কিত এই নিয়মটি কেবলমাত্র যৌন হয়রানি রোধের ক্ষেত্রে কোনো নিশ্চয়তা তো দেয়ই না বরং তাদের একাডেমিক এবং সামাজিক বিকাশকেও মারাত্মকভাবে বাধা দেয়। এই নিয়মের ফলে ছাত্রীরা ক্লাবের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে অংশ নিতে বা ক্লাসরুমের বাইরে সামাজিক সম্পর্কও গড়ে তুলতে পারছেন না।
এছাড়া আইইউটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ছাত্রদেরও “কারফিউ” নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং রাত ১০টার মধ্যে ক্যাম্পাসে থাকতে হবে।
তবে, ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কারফিউ শুধুমাত্র নামে জারি ছিল। তারা যেকোনো সময়ে অবাধে ঘোরাফেরা করতে পারতেন।
যৌন হয়রানি এবং বৈষম্যের এমন অগণিত ঘটনার ফলে কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছেন অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। তারা ক্যাম্পাসে থেকেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ভোগান্তির গল্প
উর্মি জাহান (ছদ্মনাম) আইইউটি’র ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ১৬ ব্যাচের ছাত্রী। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ক্লাস চলাকালে এক ছাত্রের হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হন তিনি।
ঘটনার সময় উর্মি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি কারণ অপরাধীর সাহস তাকে রীতিমতো স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে ঘটনাটি নিয়ে কথা বলেছিলেন এবং তৎকালীন উপাচার্যের কাছে একটি অভিযোগও জমা দিয়েছিলেন।
এ ঘটনার এক মাস পর আইইউটির কয়েকজন শিক্ষক এবং বাইরের দুজন নারী পরিদর্শককে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
উর্মি জানান, “কমপক্ষে ছয়জন শিক্ষক এবং উপাচার্যের কাছে কী ঘটেছিল তা ব্যাখ্যা করার পর আমি আবার আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিক্রিয়া আমাকে নিরাশ করেছে।”
“তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, আমি সঠিকভাবে পোশাক পরেছিলাম কি-না এবং কেন আমি তখন চিৎকার করে কাউকে ডাকিনি বা কিছু বলিনি। অবশেষে, তারা পুরো বিষয়টি খারিজ করে দেয় এবং যে আমাকে হয়রানি করেছিল সে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে চলে যায়,” কান্নারত কণ্ঠে তিনি বলেন।
এর সাত মাস পর সেই অভিযুক্ত উর্মিকে যৌন হয়রানি করে একটি অবমাননাকর টেক্সট পাঠিয়েছিল, তবে এবার আর উর্মি বিষয়টি কাউকে জানাননি।
তিনি বলেন, আমি সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমি কোনো সহায়তা বা সহানুভূতি পাইনি।
উর্মির সঙ্গে ঘটা ঘটনাটি ক্যাম্পাসে অজানা নয় এবং এ ধরনের অপরাধীদের অধিকাংশই বিদেশি ছাত্র।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ১৮তম ব্যাচের এক ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় যৌন হয়রানি করেন কলম্বিয়ার ছাত্র গাইদাদুর উমর। পুরো ঘটনাটি একাধিক সাক্ষীর সামনে ঘটে এবং সিসিটিভিতেও ধরা পড়ে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় “নারী-সংক্রান্ত বিষয়ে” বিশেষ করে বিদেশী ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনিচ্ছুক।
তাদের এমন দুর্বল পদক্ষেপের ফলে, যৌন হয়রানি করা অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে এবং এমন ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে।
শুধু ছাত্র নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষ কর্মীদেরও বিরুদ্ধেও মেয়েদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন ব্যাচের তিনজন ছাত্রী রেজিস্ট্রার অফিস সেকশন অফিসার মো. মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
ইইই বিভাগের এক ছাত্রী আইইউটি ক্যাম্পাসের ভেতরে সাইকেল চালানোর কারণে তার হাতে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। মেয়েদের পোশাক এবং ব্যক্তিগত জীবনধারা ও চলাফেরা নিয়ে কটূক্তির জন্যও মফিজুরের কুখ্যাতি রয়েছে।
এক ছাত্রী বলেন, ২০১৭ সালে সামার সেমিস্টার পরীক্ষার সময় আমাকে রেজিস্ট্রারের অফিসে ডাকা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমার কাপড় দেখে আমাকে ভালো পরিবারের মেয়ে মনে হয় না।”
ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক এ বিষয়ে আইইউটি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা জানায়, একজন ডিনের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি এই অভিযোগের কিছু সত্যতা খুঁজে পেয়েছে এবং মফিজুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলছে।
যৌন হয়রানিবিরোধী কোনো কমিটি নেই
২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্যই যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা দেখার জন্য যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কিন্তু আইইউটিতে এমন কোনো কমিটি নেই।
এই প্রতিবেদক আইইউটি কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাক্ষাৎকারের সময়সূচি দুইবার পুনর্নির্ধারণের পর, উপাচার্য ড. এম রফিকুল ইসলাম সাক্ষাৎকারটিই বাতিল করে দেন।
রেজিস্ট্রার ড. মেওবেসা উমর ইমেইলের মাধ্যমে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রবিধানগুলো অসদাচরণ, নৈতিক স্খলন, শৃঙ্খলাহীনতা এবং শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। “অসদাচরণ” এবং “নৈতিক স্খলন” শব্দটি যৌন হয়রানিসহ এ ধরনের আচরণের আওতাভুক্ত।
প্রতিবেদকের কাছে বলা হলেও উর্মির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়নি।
মতামত দিন