সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননের জন্য গত ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দুই মাস সব ধরণের বনজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করেছিল বনবিভাগ
দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও শুরু হয়েছে সুন্দরবনে মৎস্য ও কাঁকড়া আহরণ। ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এ অঞ্চলের জেলেরা। বন অফিস থেকে পাস-পারমিট নিয়ে বনে যাচ্ছেন তারা।
সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননের জন্য গত ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দুই মাস সব ধরণের বনজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করেছিল বনবিভাগ।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো: বেলায়েত হোসেন বলেন, “নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মানেই মনে অবাধ বিচরণ ও ইচ্ছেমত যেখানে সেখানে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে মাছ ধরা যাবে এমনটা ভাবলে হবে না। প্রতিটি জেলেকেই এবারের শর্তগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। বন সংশ্লিষ্টরা এবার পাস পারমিট পাওয়া প্রতিটি জেলে বহরের ওপর কঠোর নজরদারী রাখবে। তাই বনের নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এক ইঞ্চি বা তার চেয়ে বড় ফাঁসের জাল নিতে হবে।”
বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, এবার মৎস্য আহরণে জেলেদের কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। জাল পাতার জন্য বাঁশ, কচা, রান্নার জ্বালানি কাঠ, নৌকার ছাউনি সবকিছুই নিয়ে যেতে হবে। ১৮টি অভয়ারণ্য এলাকা এবং ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত খালে কোনো জেলে বা মাছ ধরা নৌকা প্রবেশ করতে পারবে না। এক ইঞ্চির ছোট ফাঁসের কোনো জাল ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ এলাকার বাইরে জেলেরা চরপাটা জাল পেতে ও বড়শি দিয়ে মাছ এবং চাই পেতে কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন। কেউ বিষ দিয়ে মাছ শিকার বা বিধিনিষেধ অমান্য করলে তার বিএলসি বাতিল, বন আইনে জেল-জরিমানা এবং স্থায়ীভাবে তাকে বনে প্রবেশে স্থায়ী নিষিদ্ধ করা হতে পারে।
এদিকে, দুই মাসের অবরোধে চরম দুর্দিন গেছে দরিদ্র জেলেদের। মৎস্য আড়তদার এবং ব্যবসায়ীদেরও লোকসান গুণতে হয়েছে। অবরোধ খুলে দেওয়ার পর সুদ এবং ধারদেনা করে নৌকা ও জেলেদের পেছনে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে নতুন করে।
হারুন মোল্লা নামের একজন জানান, তার সংসারে ৭ জন লোক। সুন্দরবনে একদিন না গেলে তার ঘরে চুলা জ্বলে না। দুই মাসের অবরোধে দিনমজুরী করে কোনোমতে সংসার চালিয়েছেন। মহাজনের কাছ থেকেও ধার নিয়ে দেনাগ্রস্ত হয়েছেন। কবির বয়াতীসহ অন্যান্য জেলেরাও অবরোধকালিন তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন।
মৎস্য ব্যবসায়ী মো: জালাল মোল্লা জানান, তার ৮টি নৌকায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা দাদন দেওয়া। অবরোধের কারণে সেই দাদনের টাকা শোধ করতে পারেনি জেলেরা। আবার নতুন করে নৌকা খুলতে নৌকাপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে। এজন্য তিন লাখ টাকা সুদে আনতে হয়েছে তাকে।
মৎস্য আড়তদার মোশারেফ মৃধা, আব্দুর রব আঁকন এবং জাহাঙ্গীর হাওলাদার জানান, তাদের জনপ্রতি ২০-২৫টি নৌকায় ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা করে দাদন দেওয়া রয়েছে। তারপরও অবরোধের মধ্যে জেলেদের সংসার খরচ দিতে হয়েছে। এই টাকা তারা উঠাতে পারবেন কি না নিশ্চয়তা নেই।
মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, বনবিভাগ যে উদ্দেশ্যে ২ মাসের অবরোধ দিয়েছে তা সফল হয়নি। কারণ, অবরোধের মধ্যেও গোপনে চোরা মৎস্য শিকারিরা বিষ দিয়ে বনের বিভিন্ন খালে মাছ ধরেছে। তারা বিষ দিয়ে মাছের রেণু থেকে শুরু করে জলজ সম্পদের চরম ক্ষতি করছে। এতে প্রকৃত জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সব অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে জেলেরা মনে করেন।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. আব্দুল মান্নান জানান, কঠোর বিধিনিষেধ পালনের শর্তে এবার জেলেদের পাস-পারমিট দেওয়া হচ্ছে। এর আগে ১২ আগস্ট শরণখোলা স্টেশন অফিসে মৎস্য ব্যবসায়ী, আড়তদার ও জেলেদের নিয়ে অবহিতকরণ সভা করা হয়েছে। ওই সভায় তাদেরকে সকল নিয়ম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর পরও কেউ অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মতামত দিন