ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়ার পরও কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোছা. সুলতানা পারভীনসহ চারজনের পোস্টিং নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে
ঢাকা ট্রিবিউন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে সাজা দেওয়া এবং নির্যাতনের ঘটনায় ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়ার পরও কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোছা. সুলতানা পারভীনসহ চারজনের পোস্টিং নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রিটে একজনকে পোস্টিংয়ের বৈধতা এবং অন্য তিনজনকে পোস্টিং না দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- ঢাকা ট্রিবিউনের সাংবাদিককে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে এক বছরের জেল
সোমবার (২৩ আগস্ট) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় নির্যাতনের শিকার ঢাকা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগান এ রিট দায়ের করেন। রিটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করবেন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু এবং ইশরাত হাসান।
আরও পড়ুন- এক সাংবাদিক ধরতে ৪০ জনের বাহিনী, হাইকোর্টের বিস্ময় প্রকাশ!
রিট আবেদনের ওপর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মুস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হবে।
আরও পড়ুন- কাবিখা’র টাকায় পুকুর সংস্কার করে ডিসি’র নামে নামকরণ!
রিটকারী আইনজীবীরা বলেন, “ওই চারজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলমান। সেই মামলায় এখনো তারা জামিন নেননি। তাই আইনের দৃষ্টিতে এখনো তারা পলাতক। এই চারজন ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়ার পরও বরখাস্ত না করে একজনকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে এবং অন্য তিনজনকে পোস্টিংয়ের চেষ্টা চলছে, যা আইনবহির্ভূত। তাই একজনের পোস্টিংয়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্যর তিন আসামিকে যেন পোস্টিং দেওয়া না হয়, সে কারণেই হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে।”
আরও পড়ুন- আরিফুলকে 'কলেমা পড়িয়ে এনকাউন্টারে' দিতে চান সহকারী কমিশনার!
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে গত বছর ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে তার নিজ বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। এরপর তাকে এনকাউন্টারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জেলা শহরের ধরলা ব্রিজের পূর্ব পাড়ে নেওয়া হয়। পরে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন ওই সময়ের আরডিসি নাজিম উদ্দিন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা। পরে সাংবাদিক আরিফের কাছে আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন- মিথ্যা বলে তড়িঘড়ি করে আরিফুলের জামিন!
মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার হলে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় পরদিন ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন- ডিসি সুলতানা: এনকাউন্টারের ইচ্ছা ছিল না, মিডিয়া 'এভোয়েড' করো
গত বছরের ১৫ মার্চ পরিবারের আবেদন ছাড়াই সাংবাদিক আরিফকে জামিনের ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন। কারামুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারি কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামসহ অজ্ঞাত ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফ। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ৩১ মার্চ সেই মামলা রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ।
আরও পড়ুন- ‘আরিফুলকে সাজা দেওয়ার ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত ও শুনানি করে তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনকে লঘুদণ্ড হিসেবে দুই বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনের ক্ষেত্রে পদাবনতির সুপারিশ করা হয়েছে। আর এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলাম তিন বছর বেতন বৃদ্ধির সুবিধা হারাবেন। সবচেয়ে কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে সেই রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করা সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমার ক্ষেত্রে। তাকে চাকরীচ্যুত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- সাধারণ মানুষকে নির্যাতন নাজিম উদ্দিনের জন্য নতুন নয় (ভিডিও)
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে নথি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। সেই প্রক্রিয়াটি এখন চলমান। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে এসব ক্ষেত্রে সাধারণত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ীই শাস্তি হয়।
আরও পড়ুন- সাংবাদিক নির্যাতন: আরিফুলের মামলার ‘কেস ডায়েরি’ তলব
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত বলছে, সেদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় অভিযুক্তরা প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ করেননি।
আরিফুল ইসলামের অভিযোগ, তাকে নির্যাতনের ঘটনায় মূল দায়ী সুলতানা পারভীন ও নাজিম উদ্দিন। অথচ তাদের নামমাত্র শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। রিন্টু বিকাশ চাকমাকে বানানো হচ্ছে ‘‘বলির পাঁঠা’’।
তিনি বলেন, “তার জানামতে ঘটনার রাতে রিন্টু বিকাশ চাকমা দৃশ্যমান কোনো অপরাধ করেননি, শুধু বিচারিক নথিতে সই করেছিলেন। সব নির্দেশনা দিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন এবং তার কথায় স্পষ্ট ছিল যে ডিসির নির্দেশে এসব করছেন।”
আরিফুল আরও উল্লেখ করেন, এই ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। আশা করছেন আদালতেই ন্যায়বিচার পাবেন।
আরও পড়ুন- সাংবাদিক নির্যাতন: আরিফুলের বক্তব্যে একমত মোবাইল কোর্টের সেই বিচারক
রিন্টু বিকাশ চাকমার বিষয়ে গঠন করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদনেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় নাজিমউদ্দিন ও এস এম রাহাতুল ইসলামের এখতিয়ার-বহির্ভূত ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। নাজিমউদ্দিন ও রাহাতুল এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতে উপস্থিত হয়ে কীভাবে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, তারও বিবরণ রয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুন- সাংবাদিক নির্যাতন: আরিফুলের মামলার অগ্রগতিতে আদালতের সন্তুষ্টি
তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রিন্টু বিকাশ চাকমা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, তিনি আরডিসি নাজিম উদ্দিনের প্রচণ্ড চাপাচাপিতে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাজা পরোয়ানায় সই করতে বাধ্য হন। এজন্য তিনি নবীন কর্মকর্তা হিসেবে অনুকম্পা প্রার্থনা করেন।
আরও পড়ুন- ‘গুরু পাপে লঘু শাস্তি’ পেতে যাচ্ছেন সাংবাদিক পেটানো সেই ডিসি-ম্যাজিস্ট্রেট
রিন্টু বিকাশ চাকমার দায় কেন বেশি তা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ভাষ্যমতে ‘‘ম্যাজিস্ট্রেট’’ শব্দটি দিয়ে কেবল একজন মনোনীত ব্যক্তিকে না বুঝিয়ে আদালতকে বোঝায়, যেখানে ন্যায়বিচার পরিচালনা করা হয়। সুতরাং রিন্টু বিকাশ চাকমা দায় এড়াতে পারেন না। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করে এবং কর্তব্যে চরম অবহেলা করে অসদাচরণ করেছেন।
মতামত দিন