গুণী এ নাট্যজন স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে
রবীন্দ্রোত্তর কালে সবচেয়ে শক্তিশালী নাট্যব্যক্তিত্ব ড. সেলিম আল দীন। ১৯৪৯ সালের এই দিনে (১৮ আগস্ট) ফেনী জেলার সোনাগাজি থানার সেনেরখিল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন বাংলা নাটকের শেকড়সন্ধানী নাট্যকার সেলিম আল দীন।
ঔপনিবেশিক সাহিত্য ধারার বিপরীতে গিয়ে বাংলা নাটককে আবহমান বাংলার গতিধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। তিনি ঔপনিবেশিকতার অবলেশ থেকে মুক্তি দিয়েছেন বংলা নাটককে। বাংলা নাট্যমঞ্চে অনুবাদনির্ভর নাট্যচর্চার যে রীতি গড়ে ওঠেছিল সেখানে তিনি প্রতিস্থাপন করেন বাংলা ভাষার মৌলিক নাটককে। নাটকে বিষয়, আঙ্গিক আর ভাষা নিয়ে গবেষণা ও নাটকে তার প্রতিফলন তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা নাটকের যে আন্দোলন, তার পেছনেও রয়েছে সেলিম আল দীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শেকড়ের সন্ধানে মগ্ন ছিলেন।
জন্ম ফেনীতে হলেও বাবার চাকরির সূত্রে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেয়ার পর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকেই তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হতে থাকে। একদিকে সৃজনশীলতার ভুবন আলোকিত করে রাখেন তার নতুন নতুন ভিন্নমাত্রিক রচনা সম্ভার দিয়ে, অন্যদিকে শিল্পের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য কাজ করে যান সমান্তরালে। ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই খোলা হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এই বিভাগকে তিনি অধিষ্ঠিত করেন মর্যাদার আসনে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সারাদেশে নাট্য আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে ১৯৮১-৮২ সালে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। এর আগেই শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক নিয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার সম্পাদনায় নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগ বিভাগ থেকেই প্রকাশিত হতো নাটক বিষয়ক পত্রিকা ‘থিয়েটার স্টাডিজ’।
নাটক রচনার পাশাপাশি নাটক নিয়ে তিনি গবেষণা চালিয়ে গেছেন আজীবন। বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ ‘বাংলা নাট্যকোষ’ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন তিনি নিজেই। তার রচিত ‘হরগজ’ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ কেন্দ্রিক এথনিক থিয়েটারেরও উদ্ভাবনকারী তিনিই।
সেলিম আল দীনের লেখা নাটকের মধ্যে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’, ‘প্রাচ্য’, ‘হাতহদাই’, ‘নিমজ্জন’, ‘ধাবমান’, ‘পুত্র’, ‘বনপাংশুল’ উল্লেখযোগ্য। ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে তার গবেষণাধর্মী নির্দেশনা ‘মহুয়া’ ও ‘দেওয়ানা মদিনা’। তার রচিত ‘চাকা’ ও ‘কীত্তনখোলা’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমি ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার প্রাপ্ত ড. সেলিম আল দীন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
কীর্তিমান এই নাট্যজন স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে এবং ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সেলিম আল দীন স্মরণে কর্মসূচি:
নাট্যজন সেলিম আল দীনের ৭২তম জন্মদিন স্বরণে বুধবার (১৮ আগস্ট) বুধবার সকাল ১০টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটি শোভাযাত্রা বের করা হবে। শোভাযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে সেলিম আল দীনের সমাধিস্থলে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যে দিয়ে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ সময় শোভাযাত্রায় সেলিম আল দীনের বিখ্যাত গান পরিবেশন করা হবে।
দুপুর ১২টায় বারীণ ঘোষের ছবির গল্পে সেলিম আল দীন। বিকাল ৩টায় মাস্টার ক্লাস: সেলিম আল দীনের বিশ^বীক্ষা। এতে বক্তা হিসেবে থাকবেন- অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ। বিকাল ৪টায় ড. ফাহমিদা আক্তারের সঞ্চালনায় “চলচ্চিত্রে সেলিম আল দীন”। এতে অতিথি হিসেবে থাকবেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মোরশেদুল ইসলাম, আবু সাইয়ীদ, নার্গিস আক্তার। বিকাল ৫টায় ইউসুফ সাকী ব্যানার্জি পরিবেশিত রেকর্ডেড সঙ্গীতানুষ্ঠান “তোমাকে শোনাবো বলে সেলিম আল দীন” প্রাচারিত হবে। অনুষ্ঠানগুলো নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যাবে।
এ বিষয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি ড. সোমা মুমতাজ বলেন, “মহামারির এই অবস্থায় আমরা তেমন কোন আয়োজন করছি না। তবে ঢাকা থেকে আগত অতিথি এবং শিক্ষকরা আসবেন তারা একসাথে ফুল দিতে যাবেন।”
এছাড়া বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ও ঢাকা থিয়েটার যৌথ আয়োজনে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের ফেসবুক পেজে দিন রাত ৮টায় আলোচনা সভা। রাত ৯টায় “সেলিম আল দীনের রচনা থেকে পাঠ”। এছাড়া রাত সাড়ে ৯টায় সঙ্গীতানুষ্ঠান “তোমাকে শোনাবো বলে সেলিম আল দীন।”
মতামত দিন