যথাযথ মনিটরিং না থাকায় কারখানা কর্তৃপক্ষ শিশুশ্রমের মতো অপরাধমূলক কাজ করে আসছিল
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজের কারখানাটিতে শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। যদিও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনকে অস্বীকার করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ।
সোমবার (৯ আগস্ট) দুপুরে তদন্ত কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ কোম্পানির ছয়তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গত বৃহস্পতিবার ৪৪ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে কারখানাটিতে শিশুশ্রমের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তদন্ত কমিটি অগ্নিকাণ্ডে আহত ৩৬ শ্রমিক ও নিহত ৫১ শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। এছাড়া ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গেও কথা বলেছে। প্রত্যেকেই শিশুশ্রমের বিষয়টি আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া হাসনাইন নামে ১৩ বছর বয়সী এক শিশু শ্রমিকের লাশও আমরা পেয়েছি। এ থেকে প্রমান হয় যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের (কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর) দায়িত্ব পালনে ঘাটতি ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “যথাযথ মনিটরিং না থাকায় কারখানা কর্তৃপক্ষ শিশুশ্রমের মতো অপরাধমূলক কাজ করে আসছিল। শ্রমিক নিরাপত্তা ও শিশুশ্রমের ওপর ২০টি সুপারিশসহ ৪৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি শ্রম মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পাঠাব। তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”
এদিকে, জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে শিশুশ্রম প্রমাণিত হলেও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া।
তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা কারখানটিতে কোনো শিশুশ্রম পাইনি। অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিক ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের বয়স ১৪ বছরের ওপরে ছিল। এখন তদন্ত প্রতিবেদনে যদি শিশুশ্রমের কথা বলে, তাহলে এ ব্যাপারে তারা ভালো বলতে পারবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে আসেনি।”
তিনি আরও বলেন, “তদন্ত প্রতিবেদনে যদি শিশুশ্রমের বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তো অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই কারখানাটির বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া আমরা শ্রম আইন অনুযায়ী স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এমন আহত শ্রমিকদের আড়াই লাখ করে টাকা ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়ার জন্য নোটিশ পাঠিয়েছি। তারা যদি এ নির্দেশ না মানে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আবারও মামলা করা হবে।
ভবনের নিচতলায় কমপ্রেসার কক্ষে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন:
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম ব্যাপারী জানিয়েছেন, আগুন মূলত লেগেছে নিচতলায় ভবনের মূল কমপ্রেসার কক্ষের ভেতরে বৈদ্যুত্যিক শটসার্কিট থেকে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য থাকার কারণে পুরো ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, “আমরা ঘটনাস্থলে থাকা এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, আগুন নেভানো যন্ত্রপাতি না থাকায় তিনি মাল ওঠা-নামার যন্ত্র দিয়ে অনেককে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ৩য় তলা পর্যন্ত যেতে যেতে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির দুটি সিঁড়ি থাকলেও বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। তাদের ভবনের নকশা আমরা পেয়েছি, কিন্তু নকশায় সংশ্লিষ্ট সংস্থার কোনো অনুমোদন ছিলো না। অনুমোদন ছাড়াই ভবনটি নির্মাণ করে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।”
তিনি আরও জানান, এছাড়া কারখানার লাইসেন্স থাকলেও তা যথাযথ ছিলো না। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। এখন লাইসেন্স ছাড়া কারখানা কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হচ্ছিল এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।
উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় আগুনে পুড়ে নিহত হন ৫২ জন শ্রমিক-কর্মচারী। এর মধ্যে দুই নারীসহ ৩ জনের লাশ হস্তান্তর করা হলেও বাকি ৪৯ জনের লাশ পুড়ে যাওয়ায় হস্তান্তর করতে ডিএনএ টেস্ট করা হয়। শনিবার পর্যন্ত ৪৫ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ঘটনায় ১০ জুলাই রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানা মালিক আবুল হাসেম, তার চার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর ওইদিনই হাসেম ও তার চার ছেলেসহ প্রতিষ্ঠানটির আটজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে চার দিনের রিমান্ড শেষে ১৪ জুলাই জামিন আবেদন করা হলে ১৯ জুলাই হাসেম ও তার দুই ছেলের জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। এর আগে গত ১৫ জুলাই মামলার তদন্তভার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মতামত দিন