হাসপাতালটির ৬টি ভবন এখন ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কিছু ভবন ব্যবহৃত হচ্ছে হাঁস-মুরগির খামার হিসেবে
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ২০০৬ সালে নির্মাণ করা হয় ২০ শয্যা বিশিষ্ট গোহারুয়া হাসপাতাল। নির্মাণের ১৫ বছর অতিবাহিত হলেও কখনই হাসপাতালটিতে পুরোদমে সেবা কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। ফলে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চার উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালটির ৬ টি ভবন এখন ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে এর অনেক অবকাঠামো। আর হাসপালের আশেপাশের এলাকা এখন গোচারণ ভূমি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১৫ এপ্রিল হাসপাতালটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০৬ সালের ১৭ অক্টোবর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান এই হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। হাসপাতাল ভবন ছাড়াও চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের জন্য আরও তিনটি দ্বিতল ভবন ও দুইটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো চিকিৎসক নিয়োগ না দিয়েই উদ্বোধন করায় শুরুতেই হোঁচট খায় হাসপাতালটি।
এলাকাবাসীর দাবিতে ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য সচিবের কাছে হাসপাতালটি চালু ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে চিঠি দেন কুমিল্লার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান। ওই বছরই হাসাপাতালটির জন্য ছয়জন ডাক্তার ও ছয়জন নার্সের মোট ১২টি পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু জুন মাসে নিয়োগ দেওয়া হয় মাত্র একজন চিকিৎসা কর্মকর্তাকে। ওই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি এ হাসপাতালে ছিলেন কাগজে কলমে। তিনি যাওয়ার পর দুই নারী চিকিৎসক, একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও গাইনি বিশেষজ্ঞ কিছুদিন দায়িত্ব পান। তাদের কেউ বাস্তবে আসেনি। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই হাসপাতালের কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে শুরুর জন্য বিভিন্ন জনের কাছে আবেদন জানানো হলেও কোনও লাভ হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, বহির্বিভাগে সবসময় ডাক্তাররা আসেন না। মাঝেমাঝে দুই-একজন ডাক্তার আসেন। তারা কিছু সময় রোগী দেখে তারপর চলে যান। হাসপাতালটির জন্য কোনো ওষুধ বরাদ্দ নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ওষুধ নিয়ে রোগীদের প্রদান করা হয়। তবে তা যথেষ্ট নয়।
সরেজমিন হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠে গরু চরছে। হাসপাতাল ব্যতীত বাকি ভবনগুলো দখল হয়ে গেছে। সেখানে গবাদি পশুর খাবার ও লাকড়ি রাখা হয়েছে। কিছু ভবন ব্যবহৃত হচ্ছে হাঁস-মুরগির খামার হিসেবে। চারদিকে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। সবগুলো ভবনে ঝুলছে তালা। ঝোপ জঙ্গলে ভরে গেছে পুরো এলাকা। বৈদ্যুতিক সুইচ-মিটারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আশেপাশের ভবনগুলোর ভগ্নদশা। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ডবয়কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের প্রধান ফটকে ঝুলছে তালা।
নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানায়, সর্বশেষ ২০২০ সালের জুন মাসে ৫ জনকে পদায়ন করা হলে বর্তমানে এই পাঁচজন আউটডোরে সেবা দিচ্ছেন হাসপাতালটিতে। তবে ইনডোর সেবা দেওয়ার জন্য এখনো কোনো শয্যা স্থাপন করা হয়নি। একজন করে আবাসিক চিকিৎসক, মেডিকেল কর্মকর্তা ও গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। এছাড়া একজন সিনিয়র ব্রাদার ও ওয়ার্ডবয় অন্যান্য বিষয়গুলো দেখভাল করছেন। তবে বহির্বিভাগের সেবা শেষ হলে সিনিয়র ব্রাদার ও ডাক্তাররাও হাসপাতালটি ত্যাগ করেন।
এদিকে গত ৩ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই হাসপাতাল নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন নাঙ্গলকোটের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়া। তিনি সাংসদ থাকাকালীন হাসপাতালটি নির্মাণ করেছিলেন।
ওই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, “গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল ভূতের বাড়ি ও গরু ছাগলের আড্ডাখানা!”
নাঙ্গলকোটের জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদ রানা ভূঁইয়া বলেন, “হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালু হওয়া অতি জরুরি। আমরা দীর্ঘদিন আশায় আশায় থেকেছি, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন হয়নি। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে শয্যাগুলো চালু করা হোক।”
নাঙ্গলকোট উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা দেবদাস দেব বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বছরের মধ্যে একটা ভালো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।”
কুমিল্লার সিভিল সার্জন মীর মোবারক হোসেন বলেন, “কুমিল্লায় চিকিৎসক সংকট রয়েছে। হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হলে বাড়তি চিকিৎসকের দরকার হবে। যা দেওয়ার সামর্থ্য বর্তমানে আমাদের নেই। কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে গেলে ইনডোর ও আউটডোর দুটোতেই চিকিৎসা সেবা চালু করা হবে।”
মতামত দিন