পানিতে ডুবে চাচাতো বোনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলার আসামী হিসেবে পুলিশ ১৯৯৭ সালে ১১ বছর বয়সে স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী পিয়ারা আক্তারকে গ্রেপ্তার করে
চাচাতো বোন হত্যার মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ ২৪ বছর কারাভোগের পর গত ১০ জুন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মৃত আনিস মৃধার মেয়ে পিয়ারা আক্তার(৩৮)।
মুক্তির পর গত বৃহষ্পতিবার (২৪ জুন) পিয়ারা আক্তারের হাতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিয়োগ পত্র ও একটি সেলাই মেশিন তুলে দেন বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার। এসময় পিয়ারা বেগমের মতো আরও তিনজনকে ভ্যান ও সেলাই মেশিন দেয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
পানিতে ডুবে চাচাতো বোনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলার আসামী হিসেবে পুলিশ ১৯৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল ১১ বছর বয়সে স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী পিয়ারা আক্তারকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর মামলার এজাহারে তখন ১১ বছর বয়সী পিয়ারার বয়স বাড়িয়ে ১৭ বছর উল্লেখ করা হয়।
অর্থের অভাবে পিয়ারা আক্তার পক্ষে নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী লড়েন তার পক্ষে, তবে শক্ত প্রমাণ দিতে পারেননি।
১৯৯৮ সালে ১১ নভেম্বর এই হত্যা মামলার রায়ে পিয়ারাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন আদালত। সেই থেকে কারাগারে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছিলেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে পরিদর্শনে যান বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। সেখানে পিয়ারার মুখে তার জীবনের এ করুণ কাহিনী শুনে তার মনে দাগ কেটে যায়।
এরপর ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সদাচরণকারী বন্দীদের একটি তালিকা বরিশাল কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখানে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের সুপারিশে পিয়ারা আক্তারের নামও তালিকাভূক্ত করা হয়।
কারাবাসকালে সদাচরণের জন্য বিশেষ বিবেচনায় পিয়ারাসহ কয়েজন বন্দীর মুক্তির এ আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঞ্জুর করে।
অবশেষে গত ১০ জুন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজ গ্রামে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় ফিরে যান পিয়ারা আক্তার।
গত শুক্রবার (২৫ জুন) বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পিয়ারা বেগম বলেন, “পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান। এরপরই চাচা জিয়াউল হক তাদের জমি দখলের চেষ্টা করতে থাকেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে থাকা এক ব্যক্তি আমাকে ধরের থানায় নিয়ে যান।”
তোমার চাচাতো বোন মেজবিনকে তুমি সাঁকো থেকে ফেলে দিয়েছো বলে আদালতে জবানবন্দি দেবে। তাহলে তোমাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো। অন্যকথা বললে তোমাকে জেলে দেয়া হবে-সেই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করেন পিয়ারা।
তিনি বলেন, “আমি ওই পুলিশ সদস্যের শিখিয়ে দেয়া কথামতো আদালতে জবানবন্দি দিই। তবে এরপর তারা আমাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। আমার পরিবারের সদস্যরা তখনও জানতেন না আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তারা জানতেন আমি হারিয়ে বা পালিয়ে গেছি। সাত মাস পর মারামারির একটি মামলায় গ্রামের এক ব্যক্তিকে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে আমার মা ও ভাইকে বিষয়টি জানান।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, “পিয়ারা বেগমের ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে। তার জীবনের কারাভোগের দীর্ঘ ২৪ বছর ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। তবে তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা বিবেচনা করে তাকে চাকরি দেয়ার পাশাপাশি একটি সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে”
পিয়ারা বেগমের মতো আরও তিনজনকে ভ্যান ও সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। এসব উপহার তুলে দেয়ার সময় তাদের মুখের হাসি আমাকে মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানান তিনি।
মতামত দিন