ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার সাত উপজেলার মধ্যে ৬টির শতাধিক গ্রামের ৩৫ হাজার পরিবার প্লাবিত হয়েছে
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার চার উপজেলার বিভিন্ন নদীর বাঁধ ছাপিয়ে এবং বাঁধ ভেঙে ৩৫ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষ মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। জোয়ার- ভাটা চলছে উপকূলের গাবুরা, পদ্মপুকুর, প্রতাপনগরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরার সাত উপজেলার মধ্যে ৬টির শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে ওইসব গ্রাম।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের সূত্রমতে, ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে বিপুল পরিমাণ কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৩৫ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষ মানুষ। পানিতে ভেসে গেছে ছয়টি উপজেলার ৩ হাজার ৬ হেক্টর চিংড়ি ঘের ৭ কোটি টাকা ও ফসলের ক্ষেত। নষ্ট হয়েছে সুপেয় পানির আঁধার পুকুরগুলো। পানির তোড়ে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রধান প্রধান সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে না উঠলেও গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি নিয়ে বহু মানুষ বাড়ির নিকটবর্তী উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
বৃহস্পতিবার (২৭ মে) সকালে জোয়ারের চাপে পানি উন্নত বোর্ড-১ এবং -২ এর আওতাধীন ৫৩ টি পয়েন্টে বাঁধ ছাপিয়ে এবং ভেঙে ২০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে চলছে জোয়ার ভাটা।
এর আগে বুধবার (২৬ মে) সকালে এবং রাতে জোয়ারের চাপে শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাপা গ্রামে বেড়িবাঁধের চারটি পয়েন্ট, পাতাখালির দুটি পয়েন্ট, রমজাননগরের দুটি পয়েন্ট, গাবুরার তিনটি পয়েন্ট, কৈখালির দুটি পয়েন্ট, ভেটখালি জামে মসজিদের সামনে একটি পয়েন্ট, বুড়িগোয়ালিনীর তিনটি পয়েন্ট ও নূরনগর ইউনিয়নের একটি পয়েন্টসহ অন্তত: ১৭টি স্থানে পানি বেড়িবাঁধ উপচে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। এসব বেড়িবাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ায় সয়লাব হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম।
এদিকে শ্যামনগরের গাবুরার জেলেখালি, নেবুবুনিয়া, চাঁদনীমুখা, গাগড়ামারি, পদ্মপুকুরের উত্তর ও দক্ষিণ পাতাখালি, কামালকাটি, ঝাঁপা ও সোনাখালিসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম উপচে পড়া নদীর জোয়ারের পানিতে ভাসছে। গ্রামবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বালির বস্তা এবং মাটি ফেলে বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা চলছে।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিএম মাছুদুল আলম, পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এড. আতাউর রহমান, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবু ভবতোষ মন্ডল, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কামেশ মোড়ল, কৈখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আব্দুর রহিমসহ স্থানীয়রা এসব তথ্য জানান।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ. ন. ম. আবুজর গিফারী বলেন, তাৎক্ষনিকভাবে সরকারি সাহায্য হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নে নগদ ২৫ হাজার টাকা ও ২ মে. টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে কালিগঞ্জের পূর্ব নারায়লপুর গ্রামের জব্বারের মাছের ঘের সংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলা হাসপাতাল, আব্দুস সামাদ স্মৃতি মাঠ, বাস টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম কাঁকশিয়ালী নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া কালীগঞ্জ সোহরাওয়ার্দী পার্কের পাশে কাঁকশিয়ালী নদীর পানি উপচে উপজেলা সদরের বেশ কিছু এলাকা তলিয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদের কাছে যমুনা নদীর উপর নির্মিত স্লুইস গেটের পাটাতন বন্ধ থাকায় সেখান থেকে পানি উপচে নাজিমগঞ্জ বাজার ও উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। উপজেলার ঘোজাডাঙা এলাকায় কাঁকশিয়ালী নদীর বাঁধ উপচে উত্তর শ্রীপুর ও দক্ষিণ শ্রীপুরসহ তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
ভাঙনের ফলে কপোতাক্ষের পানিতে আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাট, হরিশখালি, চাকলা, রুইয়ার বিল, সুভদ্রকাটি, দিঘলারআইটসহ কয়েক পয়েন্টের বেড়িবাঁধ উপচে ও ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এছাড়াও আশাশুনি সদরের দয়ারঘাট ও বলাবাড়িয়ায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের পিরোজপুরের রাজবংশীপাড়ায় কপোতাক্ষ নদের বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আশাশুনির দয়ারঘাট ও বলাবাড়িয়ায় খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ উপচে পানি এলাকায় ঢুকে কয়েক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বড়দল ইউনিয়নের বামনডাঙ্গা বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকছে।
এদিকে দেবহাটা উপজেলার ইছামতী নদীর কোমরপুর নামকস্থানে বেড়িবাঁধ উপচে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাড়দ্দহ মসজিদের পাশে ও তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে টিআর এম এর বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন স্থানে কালভার্ট ধসে নদীর পানি ছড়িয়ে পড়েছে। শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সেতু উপচে চুনা নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকা। এখন পর্যন্ত কোন প্রাণহানির কোন খবর পাওয়া যায়নি। তবে গ্রামবাসী গবাদিপশু ও তাদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছেন। সাতক্ষীরায় দিনভর বৃষ্টি হয়েছে সেইসাথে ঝড়ো হাওয়া ছিল প্রবল।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, “ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে বিপুল পরিমাণ কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পানি বন্দী হয়ে পড়েছে জেলার ৩৫ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষ মানুষ। পানিতে ভেসে গেছে ছয়টি উপজেলার ৩ হাজার ৬ হেক্টর চিংড়ি ঘের এতে ক্ষতি হয়েছে ৭ কোটি টাকা।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার নদীগুলোতে পানি বেড়ে আশাশুনির প্রতাপনগর শ্যামনগরের গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনি, কৈখালী, পদ্মপুকুরসহ কয়েকটি ইউনিয়নের বেড়িবাধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া নদীর পানি বেড়ে বেড়ি ছাপিয়েও পানি প্রবেশ করেছে। কিছু মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে।”
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চেয়ারম্যানগণ সক্রিয় রয়েছেন। ভাটা নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পানি নিষ্কাশনের কাজ করছেন।
মতামত দিন