সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঈদের ছুটিতে জমায়েত করায় এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি লঙ্ঘন করে ভ্রমণ করায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেড়েছে
ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৩০টি সীমান্তবর্তী জেলার মধ্যে সাতটি জেলাতেই হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঈদের ছুটিতে জমায়েত এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি লঙ্ঘন করে ভ্রমণ করায় সংক্রান্ত বেড়েছে।
তবে, জেলার সিভিল সার্জনরা জানিয়েছেন তারা এখনও নিশ্চিত নন আক্রান্তরা করোনাভাইরাসের মারাত্মক ভারতীয় ধরন দ্বারা আক্রান্ত কিনা।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটে সংক্রমণের আর বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই সাতটি জেলার মধ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত কয়েকদিনে সর্বাধিক সংক্রমণ দেখা গেছে।
দেশটি গত ১৪ মে ঈদুল ফিতর উদযাপনের আশেপাশের সময়েও এই জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার যথেষ্ট কম ছিল। তবে গত এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে।
মোবাইল অপারেটরদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ১২ দিনের মধ্যে প্রায় এক কোটি মোবাইল গ্রাহকরা ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তাদের মধ্যে ২৩ মে পর্যন্ত ৭৯ লাখ গ্রাহক রাজধানীতে ফেরত এসেছে।
যদিও ঈদের ছুটির আগেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা, নিজ শহরে যাতায়াত করার প্রবণতার কারণে ইদের পর সংক্রমণের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছিলেন।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রাক্তন উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম ঈদের আগে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, “দেশে করোনাভাইরাসের তৃতীয় তরঙ্গের ঝুঁকিতে আছে দেশ এবং আমি মনে করি, সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাবে। হয়ত ঈদের ১৫ দিন পর এটা বোঝা যাবে।”
পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর
সোমবার (২৪ মে) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সংক্রমণের হার ছিল ৫৫% যা ৬ দিন আগেও ছিল ২২%। জেলার সিভিল সার্জনের অফিস সূত্রে জানা গেছে, সংক্রমণ রোধে মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন জারি করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে বিশেষ এই লকডাউনের আওতায় একমাত্র জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনজুরুল হাফিজ বলেন, লকডাউন চলাকালীন কেউ জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে পারবেনা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী মনে করেন কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ার কারণ কেউ সুরক্ষা নির্দেশনা মেনে চলছিল না।
তিনি বলেন, “সহজ কথায় বলতে গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি ভয়াবহ। অনেকে জেলার বাইরে থেকে এসেছিলেন এবং অনেকেই জেলা থেকে বাইরে চলে গিয়েছিলেন। শিবগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কেউই স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানেন না। অনেককেই জরিমানা বা জেল করা হয়েছে, তারপরও কেউ মাস্ক পরতে চায় না।”
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব বলেন, “আইন প্রয়োগকারীরা মাঠ পর্যায়ে অবস্থান করে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসনকে লকডাউনটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে সহায়তা করবে। এছাড়া জেলার সমস্ত প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকবে যাতে কেউ জেলার মধ্যে প্রবেশ করতে বা ছেড়ে যেতে না পারে।”
ভারতীয় ধরন নিয়ে উদ্বেগ
ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেই মূলত সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রামক ভারতীয় ধরনটিকে “বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয়” হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ভারতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রামক ধরনগুলো সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে কিনা সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ সরকার সংক্রমণ রোধে গত এপ্রিল মাস থেকেই প্রতিবেশী দেশটির সাথে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে।
সংক্রমণ বাড়লো কেন?
ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণের হার বাড়ছে বলে মনে করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী।
তবে স্থানীয়দের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধিনিষেধের প্রতি অবজ্ঞাকে বেশি দায়ী করেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সীমান্ত অতিক্রমের কারণে এই বৃদ্ধি হয়েছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নন তারা। তবে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৪২ জন কোভিড রোগির নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
রাজশাহী সিভিল সার্জন ডাঃ কাইয়ুম তালুকদার মনে করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে মানুষের স্বাস্থ্য বিধি লঙ্ঘন ও অন্য জেলায় অবাধ চলাফেরার কারণে রাজশাহীতে সংক্রমণের হার বেড়েছে। সোমবার রাজশাহীতে সংক্রমণের হার ছিল ৩৩ শতাংশ।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো রাজশাহীর পরিস্থিতি ততটা খারাপ ছিল না, তবে আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
“আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি। অন্যান্য জেলা থেকে আগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে; এছাড়া বিশেষ করে নিশ্চিত করা হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কেউ যেন এখানে আসতে না পারেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য নজরদারিও বাড়ানো হচ্ছে,” বলে জানান তিনি।
সংক্রমণের হার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটি কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা আগেই জানতাম এমন কিছু ঘটবে। তাছাড়া সীমান্ত অঞ্চলে সর্বত্র পরিস্থিতি এক রকম নয়। মূল সমস্যা জনগণের সচেতনতার অভাব। যখন ঈদের মধ্যে বিশাল সংখ্যক মানুষ রাজধানী থেকে দেশের অন্যান্য অংশে চলে যান, তখন সংক্রমণের হার বাড়ার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে এবং এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ”
দেশে প্রাপ্ত ভারতীয় ধরন
স্বাস্থ্য পরিসেবা অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৯ জনের দেহে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি পাওয়া গেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ শেষ হলে আরও সহজে ভারতীয় ধরনটি চিহ্নিত করা যাবে।
এদিকে, বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে সাতক্ষীরায় ফিরে আসা ১৭ বাংলাদেশি নাগরিক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তারা ভারতীয় ধরনটিকে আক্রান্ত কিনা জানার জন্য নমুনাগুলো আইইডিসিআর-এ প্রেরণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ হুসেন শাফায়াত জানান, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ওই ১৭ কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়েছে। তাদেরকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি পৃথক ইউনিটে রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে।
মতামত দিন