চকবারা গ্রামের মফিজুল ইসলাম বলেন, আইলার আগে তাদের কৃষি জমি ছিল পাঁচ বিঘা। আইলা ও আম্পানের পর কৃষি নেই
ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের পর একযুগ পার হলেও রয়ে গেছে তার ক্ষতচিহ্ন। এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি সাতক্ষীরার ক্ষতিগ্রস্ত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের মানুষ।
ক্ষতিগ্রস্থ এসব এলাকায় রাস্তা নির্মাণ হয়েছে, নতুন ঘর তৈরি হয়েছে। কিন্তু এলাকায় কৃষি নেই, চিংড়ি চাষেও মন্দা। কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধের অবস্থা নাজুক। এরপরও ফণি, বুলবুল, আম্পানের মতো ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হওয়া সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় “ইয়াস” আঘাত হানতে পারে এ আশঙ্কায় ওইসব জনপদে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার চারিধারে নদীবেষ্টিত গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, ২০০৯ এর এই দিনে মাত্র ৩০ মিনিটের তাণ্ডব বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল শ্যামনগরের দুটি ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুর। এছাড়াও বিধ্বস্ত হয় আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। ৩৬টি গ্রামের ৭৩টি জীবন মুহূর্তেই কেড়ে নিয়েছিল আইলা। নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ায় গৃহহীন হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল সড়ক ধারে ও উঁচু স্থানে। টানা দুই বছর তারা সেখানে কাটিয়ে অবশেষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ঘর বাড়ি পেয়েছেন তারা। কিন্তু এলাকায় কাজ না থাকা আর বারবার দুর্যোগের মুখে বসতি টিকছে না তাদের। কাজের খোঁজে বেরিয়ে যাচ্ছেন দুর্গত মানুষ।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসেবার নাজুক অবস্থা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে। বেড়িবাঁধগুলো আশঙ্কাজনক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে নানা সমস্যা। সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট। রমজান মাসে তীব্র গরমে মানুষকে লবণাক্ত পানি পান করতে হয়েছে। সুপেয় পানির জন্য বরাদ্দকৃত জেলা পরিষদের পুকুরগুলি গত বছরের আম্পানে ভেসে যাওয়ায় আজো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।
গাবুরা ইউনিয়নের খলিষাবুনিয়া গ্রামের কৃষিজীবী আবু বক্কর ছিদ্দিক জানান, ২০০৯ সালে আইলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। সরকারিভাবে বাঁধ মেরামত করা হলেও তা মজবুত না হওয়ায় প্রতি জোয়ারে তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়।
চকবারা গ্রামের মফিজুল ইসলাম বলেন, আইলার আগে তাদের কৃষি জমি ছিল পাঁচ বিঘা। আইলা ও আম্পানের পর কৃষি নেই। কাজ নেই। এখন সবই চিংড়ি ঘের। রাস্তাঘাট ও অব্দা ঝুঁকিপূর্ণ। ছয় মাস তিনি ইটভাটায় কাজ করেন। আর ছয় মাস বাড়িতে এসে কর্মহীন হয়ে অলস সময় পার করেন।
ডুমুরিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম, পাখিমারা গ্রামের ছখিনা বেগম ও গৃহবধু রিজিয়া বেগম বলেন, সাতক্ষীরার ছোট দ্বীপ গাবুরা। আইলার পর থেকে দূর থেকে পানি আনতে হয়। লবণ পানি সহ্য করতে না পেরে ডায়েরিয়া হয়। দুষিত পানিতে ঘা, পাচড়াসহ নানান চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। ডাক্তার নেই, নার্স নেই। ডাক্তার দেখানে অনেক দূরে শ্যামনগরে যেতে হয়। রাস্তা ভাল না হওয়ায় রোগী আধমরা হয়ে যায়।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ডালিম কুমার ঘরামী বলেন, ২০০৯ সালে আইলা পরবর্তী সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে তেমন কোন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। সাধারণ হত দরিদ্র মানুষ বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকা, খুলনা ও যশোরে যেয়ে রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক চালিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। এ এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হয়নি। চিকিৎসার জন্য ২৫ কিলোমিটার দূরে শ্যামনগরে যেতে হয়। বেড়িবাঁধের অবস্থা খারাপ।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা। ১৫ ফুট উচ্চতায় ধেঁয়ে আসা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে সুন্দরবন উপকুলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায়। এসময় তিনটি ইউনিয়নের ৭৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হন। নিমিষেই গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ আর ভেঙে চুরমার হয়ে যায় স্বাস্থ্য, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ৪ মে ফণি ও ২০২০ সালের ২০ মে আম্পানের আঘাতে আবারও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় এলাকার লোকজন।
মতামত দিন