উপবৃত্তি কর্মসূচির ফলে মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয়ে ভর্তি বৃদ্ধি, নারীদের কর্মসংস্থান এবং বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে; মডেলটি পাকিস্তান, রুয়ান্ডা এবং ঘানাতেও অনুসরণ করা হয়েছে
বাংলাদেশ প্রায় তিন দশক আগে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি বিনিয়োগ পরিকল্পনার ফল পাওয়া গেছে বহুগুণে- কেবল মেয়েদের ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বাল্যবিয়ে ঠেকাতেও।
২৬ বছর ধরে ১৭০০ টিরও বেশি পরিবারে চার দফা সমীক্ষা চালানো হয় এমনই এক সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি চালু স্বল্প সময়ে শিক্ষার ফলাফলকে উন্নত করেছে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, দীর্ঘমেয়াদে, মাধ্যমিক উপবৃত্তি ও সহায়তা কর্মসূচি (এফএসএসএপি) বিয়ে বিলম্বিত করতে, চাকরিজীবী নারীদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান এবং নিরপেক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং তাদের শিক্ষিত ও চাকরিজীবী পুরুষদের বিয়ে করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে সফল।
সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের উপবৃত্তি কার্যক্রম গর্ভনিরোধক ব্যবহার বাড়াতে, উর্বরতা হ্রাস করতে এবং কন্যাদের পছন্দ বাড়িয়ে তুলতে সফল হয়েছে।
গবেষণাটির অন্যতম সহকর্মী হুসেন সামাদ গতকাল ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, "একটি রক্ষণশীল অনুমান দেখায় যে উপবৃত্তির প্রোগ্রামের সুবিধা উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২০০% ছাড়িয়ে গেছে।"
সমীক্ষাটি করেন বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন গবেষণা গ্রুপের প্রাক্তন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ শহিদুর রহমান খন্দকার; হুসেন সামাদ, এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) পরামর্শক; এডিবির অর্থনীতিবিদ রয়তারো হায়াশি এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নবুহিকো ফুওয়া।
১৯৯৪ সালে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভর্তি বৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় উপবৃত্তি চালু করে বাংলাদেশ। পরবর্তীতে সকল সরকার এই কর্মসূচিটি অব্যাহত রাখে এবং আরও প্রসারিত করে যার ফলে মেয়েদের ভর্তির সংখ্যা এখন মাধ্যমিক স্তরের ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে।
মেয়েদের উপবৃত্তি কর্মসূচির অন্যতম মূল উদ্যোগ হিসাবে উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (ডিএসএইচই) বলে, ১৯৯৪ সালে প্রবর্তিত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের উপবৃত্তি কার্যক্রম দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করেছে সরকার।
ডিএসএইচই-র একটি ওয়েব পোস্টে জানা যায়, “সত্যিই বলা যেতে পারে যে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ দেশব্যাপী মেয়েদের উপবৃত্তি কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রী ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে অনেক ভাল করেছে। এখন সরকার মাধ্যমিক শিক্ষায় অত্যন্ত দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।”
বাংলাদেশ বৃহত্তর স্তরের মেয়েদের উদ্দেশ্যে শর্তাধীন নগদ অর্থ স্থানান্তরের পথিকৃৎ হওয়ার পর পাকিস্তান এবং কিছু আফ্রিকান দেশ যেমন রুয়ান্ডা এবং ঘানাতে এটি অনুসরণ করা হয়। শিক্ষার জন্য সামান্য আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে প্রোগ্রামটি তার লক্ষ্যগুলো ছাড়িয়ে ভাল সাফল্য অর্জন করেছে।
নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করা হলে গ্রামীণ অঞ্চলের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু প্রতিটি মেয়ের জন্য অভিন্ন উপবৃত্তি এবং টিউশন ভর্তুকি সেবা দেয়া হবে। শর্তগুলো হলো- বিদ্যালয়ে ৭৫% উপস্থিতি; পরিমাপকৃত একাডেমিক দক্ষতার কয়েক ধাপ অর্জন (শ্রেণি-স্তর পরীক্ষায় ৪৫% নম্বর); এবং মাধ্যমিক স্কুল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবিবাহিত থাকা।
বছরের পর বছর ধরে এটি নারীদের কল্যাণে একাধিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল — বিদ্যালয় অর্জন, কর্মসংস্থান, স্বামী/স্ত্রী নির্বাচন এবং প্রজনন আচরণ।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, ১৯৯১ সালে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সাক্ষরতার হার ছিল ২৬%, পুরুষদের ৪৪%। তবে সময়ের সাথে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২০০১ সালে, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সাক্ষরতার হার ৪১% ছিল এবং পুরুষদের ৫৪% ছিল। এছাড়াও, বিদ্যালয়ে ভর্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য, বিশেষত মাধ্যমিক স্তরে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে পুরুষ ৪৩% এবং নারী ৪১% ছিল। এই পরিসংখ্যান ২০১৮ সালে ৬১% (পুরুষ) এবং ৭২% (নারী) এ উন্নীত হয়েছে।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, মেয়েদের জন্য বর্ধিত শিক্ষাগত অর্জন বিয়ে বিলম্বের সাথে জড়িত এবং শিশুদের মাঝে বৃহত্তর মানব মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে উর্বরতা ও গর্ভধারণের হার কমাতেও জড়িত। প্রাথমিক শিক্ষার চেয়ে মাধ্যমিকে এর প্রভাবগুলি আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বছরের পর বছর প্রতিটি মেয়ের জন্য সম্মিলিত উপবৃত্তি ও টিউশন ভর্তুকি ছিল বেসরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ৯০৬ টাকা এবং সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ৮৪৭ টাকা। উপবৃত্তি প্রোগ্রামটির মোট ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশই প্রোগ্রাম সহায়তায় খরচ করা হয়। এই প্রোগ্রামটিতে প্রতি বছর ২০ লাখেরও বেশি মেয়েকে সহায়তা করা হয়।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, উপবৃত্তি প্রবর্তনের পরের বছরগুলোতে বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং মাধ্যমিক স্তরের মেয়েদের প্রাপ্তি উভয়ই ছেলেদের সংখ্যাকে অতিক্রম করেছে। এছাড়াও, এফএসএসএপি চালু হওয়ার পর প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের বয়স পুরো এক বছর বেড়েছে।
এই গবেষণার ফলাফল এমন এক সময়ে এসেছে যখন ইউনেস্কোর অনুমান যে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী পুরো বা আংশিকভাবে বিদ্যালয় বন্ধের কারণে পড়ার জন্য লড়াই করছে। আশঙ্কা করা হয়, ২০২০ এবং ২০২১ সালে ১১ মিলিয়ন মেয়ে বিদ্যালয়ে ফিরে আসতে পারবে না এবং বিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যান্য মহামারিতে যেমনটা ঘটেছিল, পরিবারের আয় হ্রাস মেয়েদের গৃহকর্মের জন্য বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করতে পারে।
যেহেতু, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে লড়াই করছে, মেয়েদের অন্তর্ভুক্ত করতে বাংলাদেশের সাফল্য শিক্ষাবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজনীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
মতামত দিন