ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস হটলাইন- ৯৯৯ বাল্যবিয়ে রোধ করতে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ৪৫% বেশি কল পায়
বছর খানেক আগে ১৬ বছর বয়সী সামিরা ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে জামালপুর জেলার বালিকা দলে জায়গা করে নেয়। তবে কোভিড-১৯ মহামারি এবং এর ফলস্বরূপ লকডাউনে তার সকল পরিকল্পনা পণ্ড হয়।
মহামারিতে কেবল খেলাধুলা ও একাডেমিক ক্রিয়াকলাপ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়নি, বরং সামিরার ভাই ও বাবার উপার্জনও বন্ধ ছিল। জমিতে বা বাজারে কাজ করতে না পারায় তার পরিবার হতাশ হয়ে পড়ে এবং সামিরার স্বপ্নগুলো পূরণে তাদের সামর্থ না থাকার বিষয়টিও তারা বুঝতে পারেন।
সামিরার বাবা ও ভাই যুক্তি দেখান, যৌতুক ছাড়াই তাকে বিয়ে দেয়া সবচেয়ে ভাল বিকল্প হবে। তবে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া সামিরা সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিল এবং নিজেকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল।
সামিরা জানায়, “বিয়ে করে সংসার শুরু করার মানসিকতা আমার ছিল না। আমি আমার জীবনের সেই পর্বের জন্য প্রস্তুত নই। আমার বাবা-মা আমাকে যখন আমার বিয়ের ব্যাপারে বলেছিলেন, তখন আমি মন খারাপ করেছিলাম এবং ভাবছিলাম যে আমি তাদের জন্য বোঝা কিনা।”
তার মা ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেছেন, “আমরা কী করব তা আমরা জানি না। যেহেতু সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছেনা, তাই আমরা তার বিয়ের কথা ভাবছিলাম। োনাবাল্যবিবাহ এড়াতে সবাই আবার সামিরার মতো এতোটাও ভাগ্যবান নয়।
পরিবারটির এক প্রতিবেশী, কিশোর বয়সেই যাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়, তিনি বলেন, “বাবা-মা সবসময় আমাদের থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে। যখন করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন কার্যকর করা হয়, তখন বয়স্ক ব্যক্তিরা সবাই বাবা-মায়েদের তাদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন।"
বাল্যবিয়ের আরেক শিকার দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জানিয়েছেন যে তাকে বিয়ের জন্য বাধ্য করা হয় এবং তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার কোন সুযোগও পাননি যারা এই বিয়ে বন্ধ করতে পারতেন।
এমজেএফ: ২০২০ সালে বাল্যবিয়ে ৪৪% বৃদ্ধি পেয়েছে
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) দ্বারা সংগৃহীত বাংলাদেশি সংবাদপত্রের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে বাল্যবিয়ের ঘটনা ৪৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে যেখানে ৭০টি বাল্যবিবাহ ছিল, করোভাইরাসের কারণে সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ১০১ টিতে দাঁড়ায়।
এমজেএফের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রাফিজা শাহিনের মতে, দেশে বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি কেননা অনেক ঘটনাই উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিবেদিত হয় না।
তিনি বলেন, "যখন আমাদের অংশীদার সংগঠন বস্তি, গ্রাম, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডগুলিতে কাজ করত, তারা এমন অনেক ঘটনা খুঁজে পেত যেগুলোর স্থানীয়ভাবে পারস্পরিক মীমাংসা হয়েছিল এবং এমন কিছু ঘটনা যেখানে পরিবারকে সামনে আসতে এবং কথা বলতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। আমরা আমাদের প্রমাণ ভিত্তিক প্রতিবেদনে এ জাতীয় ঘটনাগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে পারি নি, তবে সেগুলি ছিল অসংখ্য।"
বাল্যবিয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ইউনিসেফ দ্বারা পরিচালিত একাধিক সূচক ক্লাস্টার জরিপ ২০১৯ অনুসারে বর্তমানে ১৫-৪৯ বছর বয়সী মোট ১৯.৮% নারীদের ১৫ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়।
২০১৯ সালের তুলনায় ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস হটলাইন ৯৯৯ বাল্যবিয়ে রোধ করতে ২০২০ সালে ৪৫% বেশি কল পেয়েছিল।
কোভিড-১৯ মহামারির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে কলের সংখ্যা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
ব্র্যাকের নারী নেতৃত্বাধীন কম্যিউনিটি ক্ষমতায়ন কর্মসূচী পল্লী সমাজের সদস্যরা ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৯৩ টি বাল্যবিয়ে রোধ করেছেন এবং বাল্যবিয়ে ৯৭ টি ঘটনা রিপোর্ট করেছেন। ২০২০ সালে তারা ৮৪৯ বাল্যবিয়ে রোধ করেছেন এবং একই সাথে বাল্যবিয়ে ১৪৬ টি প্রতিবেদন করেছেন।
কারণ ও প্রতিরোধ
ব্র্যাকের প্রোগ্রাম প্রধান (জেন্ডার ন্যায়বিচার এবং বৈচিত্র্য) সেলিনা আহমেদ বলেছেন, পরিবারের আয়ের হ্রাস, অপ্রতুল সামাজিক সুরক্ষা এবং স্কুল বন্ধের ফলে শিশুদের দীর্ঘকাল ধরে বাড়িতে থাকতে বাধ্য করায় বাল্যবিয়ে বেড়েই চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি না করাও এই বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
সেভ দ্যা চিলড্রেনের পরিচালক (শিশু অধিকার পরিচালনা ও শিশু সুরক্ষা) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সংস্থাটি বাল্যবিবাহ কমাতে সামাজিক সুরক্ষা, সচেতনতা এবং মেয়েদের পেশা-ভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর দিচ্ছে।
আর্থিক সংকট বাল্যবিবাহকে ন্যায়সঙ্গত করেনি এমনটা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এই অনিয়মকে সহজতর করেছে। সমাজের সকল সদস্যের মধ্যেই এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মুহিবুজ্জামান বলেছেন, “কেবলমাত্র যথাযথ সচেতনতাই বাল্যবিয়ের এই অভিশাপ রোধ করতে পারে। কোভিড-১৯ সংকটের সময় মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা মাঠে থাকতে না পারায় বাল্যবিয়ের মতো অনিয়ম বেড়েছে।"
"এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পরে আমরা আবার সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করব। অনেক মেয়ে আবার স্কুল খোলার পরে স্কুলগুলোতে পুনরায় যোগদানের পরিবর্তে ছিটকে পড়বে এই আশঙ্কায় আমরা প্রতিটি জেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। স্কুলগুলি আবার চালু হয়ে গেলে আমরা তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি।"
মতামত দিন