সুন্দরবনের মধ্যে থাকা পুকুরগুলো ঝড়-জলোচ্ছাসে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বছরের পর বছর ধরে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানি সংকট রয়েছে
বন্যপ্রাণীর মিষ্টি পানির চাহিদা মেটাতে বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে খনন ও পুনঃখনন করা হচ্ছে ৮৮টি পুকুর। ২৪ ঘণ্টায় ২ বার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত এই বনভূমি। একই সাথে ৩০টি পুকুরে পাকা ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। এ সব পুকুর বন্যপ্রাণীসহ সুন্দরবনে থাকা বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ বনে যাওয়া বনজীবী ও পর্যটকদেরও সুপেয় পানির চাহিদা মেটাবে।
জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়ানে এ সব পুকুর খনন ও পুনঃখননে ব্যয় হচ্ছে ৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণসহ বন্যপ্রাণীর আধিক্য রয়েছে এমন এলাকায় এ সব পুকুর খননের কাজ জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে।
এসব পুকুরের মধ্যে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে শরণখোলা রেঞ্জের দুবলায় ২টি ও বগীতে নতুন করে ৩টি পুকুর খনন করা হচ্ছে। এই রেঞ্জের ২৪টি পুকুর পুনঃখননের মধ্যে কচিখালী অভয়ারণ্যে ৪টি, কটকা অভয়ারণ্যে ৪টি, দুবলায় এলাকায় ৩টি, শরণখোলা রেঞ্জ সদরে ২টি, দাশেরভারানীতে ২টি। এছাড়া একটি করে পুকুর পুনঃখনন করা হচ্ছে ডুমুরিয়া, চরখালী, তেরাবেকা, চান্দেশর, শাপলা, ভোলা, শেলারচর, কোকিলমুনি ও সুপতি। চাঁদপাই রেঞ্জে পুনঃখনন করা ২৬টি পুকুরের মধ্যে রয়েছে ধানসাগরে ৩টি, গুলিশাখালীতে ২টি, আমুরবুনিয়ায় ২টি। একটি করে পুকুর পুনঃখনন করা হচ্ছে চাঁদপাই, ঢাংমারী, লাউডোপ, জোংড়া, ঘাগড়ামারী, নাংলী, হরিণটানা, কলমতেজী, তাম্বুলবুনিয়া, জিউধরা, বরইতলা, কাটাখালী, শুয়ারমারা, মরাপশুর, বৈদ্যমারী, আন্ধারমানিক, হারবাড়িয়া, নন্দবালা ও চরাপুটিয়ায়।
বন, পরিবেশ ও জয়লবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার তালুকদার শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনে খনন ও পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করেন। এ সময় খুলনা অঞ্চলেন বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. মইন উদ্দিন খান ও পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেনসহ বন বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উপমন্ত্রী জানান, সুন্দরবনের মধ্যে থাকা পুকুরগুলো ঝড়-জলোচ্ছাসে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বছরের পর বছর ধরে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানি সংকট রয়েছে। এ জন্য সুন্দরবনে ৮৮টি পুকুর খনন ও পুনঃখনন করা হচ্ছে। ৩০টি পুকুরের পাকা ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। যা বন বিভাগ সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর দীর্ঘদিনের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাবে। চলতি বছরের জুন মধ্যে এ সব পুকুর খনন ও পুনঃখননের কাজ শেষ হবে।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ ভাগ। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টায় ৬ বার তার রূপ বদলানো এই ম্যানগ্রোভ বনভূমি। দিনে ২ বার সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়া লবণাক্ত স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪২ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটার। সংরক্ষিত এই বনের ৩টি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট ঘোষণা করে। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ইতোধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে ১ প্রজাতির বন্য মহিষ, ২ প্রজাতির হরিণ, ২ প্রজাতির গন্ডার, ১ প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।
গোটা সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জর ১৮টি রাজস্ব অফিস, ৫৬টি টহল ফাঁড়ি রয়েছে। সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের এইজল ভাগে ছোট বড় ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল রয়েছে।
মতামত দিন