‘মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ সংস্থাগুলো তাদের ব্যয় হ্রাস করতে শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়েছে’
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রম অধিকারগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বেছে নিয়েছিল কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ।
শ্রম অধিকার কর্মীরা বলছেন, বিভিন্ন কারখানা তাদের শ্রমিকদের আরও দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করেছে অতিরিক্ত বেতন না দিয়েই, এমনকি ব্যবসায়িক মন্দার অজুহাতে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট খাতের নেতা-কর্মীরা প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে শ্রম আদালত স্থাপন এবং দেশের শ্রম আদালতে বিচারাধীন বিদ্যমান সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ইতোমধ্যে, বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শর্ত দিয়েছে যে তাদের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইইউ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৩ সালের পর ইইউর ইবিএ ব্যবস্থাপনার অধীনে প্রদত্ত জিএসপি সুবিধা নির্ভর করবে শ্রম ও মানবাধিকার সুরক্ষার ওপর। তাই দীর্ঘমেয়াদে জিএসপি সুবিধা সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশে শ্রম অধিকার প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।
শ্রমের মানদণ্ডের সাথে সম্পর্কিত আইনি, কাঠামোগত এবং প্রশাসনিক বাঁধাগুলো বাংলাদেশকে কাটিয়ে উঠতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইইউর বাজারের জিএসপি সুবিধা পেতে শ্রম অধিকার প্রয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, “শ্রম অধিকারের বিষয়গুলো এখনই সমাধান করা উচিত। ইইউ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি বড় বাজার। আমরা আমাদের পণ্যের ৫ ভাগের ৩ ভাগ এই বাজারে রপ্তানি করি।”
মোস্তাফিজুর জানান, বাংলাদেশ ২০২৪ সালের পরিবর্তে ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন (উন্নয়নশীল দেশে পরিণত) করবে। সুতরাং, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন জানান, তিনি শ্রমিকদের কাছ থেকে অনেক অভিযোগ পেয়েছেন যে মহামারি চলাকালীন তাদের কর্মঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে, এমনকি তাদের বেতনের একটি অংশ কেটে নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ সংস্থাগুলো তাদের ব্যয় হ্রাস করতে শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়েছে।”
প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে শ্রম আদালত স্থাপন করা উচিত উল্লেখ করে রাজেকুজ্জামান বলেন, “প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি মামলা শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ জন্য শ্রমিকরা তাদের অভিযোগ আদালতে তুলছেন না।”
শ্রমিকদের অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করতে একটি বিস্তৃত শ্রমনীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট আরশাদ জামাল।
তিনি বলেন, “আমরা শ্রমিকদের স্বার্থে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতি বছর আমরা ৫০ হাজার কর্মীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করছি।”
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাংলাদেশকে শ্রম মান সম্পর্কিত অনেক আইনি, কাঠামোগত এবং প্রশাসনিক বাঁধা কাটিয়ে উঠতে হবে। জিএসপি+ প্রকল্পের মাধ্যমে বাজারের প্রবেশাধিকার অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে ২৭টি আন্তর্জাতিক সনদ মেনে চলতে হবে। যার মধ্যে ১৫টি মানবাধিকার এবং আইএলও’র শ্রম আইনের সাথে সম্পর্কিত।”
তিনি আরও যোগ করেন যে ইইউ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। দেশের মোট রপ্তানির ৫৮% এবং মোট পোশাক রপ্তানির ৬৪% এই বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
এই গবেষক বলেন, “উন্নয়নশীল দেশ” হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার (এলডিসি গ্রাজুয়েশন) তিন বছর পরেও ইইউতে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকবে।
“তবে এরপর যদি ইবিএ’র অধীনে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো না থাকে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি গড়ে ৮.৭% শুল্কের মুখোমুখি হবে। অনুমান করা হয় যে চালান প্রতি বছর ৫.৭% হারে কমবে,” বলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শ্রম অধিকারের মান নিয়মিত সংস্কার নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদগুলোর সাথে তাদের সম্পূর্ণ প্রান্তিকীকরণ এখন সর্বাধিক গুরুত্বের বিষয়।”
“সম্মিলিত দর কষাকষির মাধ্যমে প্রক্রিয়াগুলো মসৃণ করতে এবং শ্রমের অধিকার নিশ্চিত করতে আইনি জটিলতাগুলোর প্রতি নজর দেয়া দরকার,” বলেন ড. মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন যে অনেক পরিবার তাদের সন্তানের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। অনেক শিশুর জীবিকার একমাত্র বিকল্প বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা।
“সুতরাং শিশুশ্রম মোকাবিলায় একটি পরিকল্পিত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধানগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার যা এই সমস্যার আর্থ-সামাজিক দিকটিও তুলে ধরে,” পরামর্শ দেন ড. মোয়াজ্জেম।
তিনি আরও জানান, অনেক শ্রমিক নিরক্ষর এবং তাই অনলাইনে নিবন্ধন পদ্ধতি অনুসরণ করা তাদের পক্ষে কঠিন। শ্রমিকদের পাশাপাশি পুরো নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সকলের যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “আশা করি, কাজ এবং এর সাথে সম্পর্কিত আইনি কাঠামোর ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উন্নতি হবে যাতে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য যোগ্য থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্বসহ একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা প্রয়োজন। এছাড়া এই ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়ানো দরকার।”
তিনি আরও দাবি করেন যে পোশাক খাতের বেশির ভাগ কারখানাগুলো কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে কাজ বন্ধ করে দেয়া এবং কর্মী ছাঁটাইয়ে নিয়ম অনুসরণ করেনি।
এই গবেষক বলেন, “করোনার সময়ে পোশাক খাতের সাড়ে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি কারখানায় শ্রমিকের গড় সংখ্যা ১০.৮% হ্রাস পেয়েছে।”
তাদের সাম্প্রতিক জরিপের কথা উল্লেখ করে ড. মোয়াজ্জেম আরও বলেন, “কোভিড সময়কালে ২৩২টির মতো কারখানা বন্ধ ছিল যা মোট কারখানার (নির্বাচিত ৩৩৪২ কারখানা) প্রায় ৬.৯%। তবে, ৯০% বড় কারখানার বিপরীতে মাত্র ৪০% ছোট কারখানা প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য আবেদন করেছিল।”
মতামত দিন