মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে গুলি বা নির্যাতন করে হত্যা করেছে বিএসএফ
গত ১০ বছরের তুলনায় ২০২০ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) দ্বারা সর্বাধিক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও দিল্লি প্রতিবার আশ্বাস দিয়ে এসেছে যে, এই হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামানো হবে।
দু'দেশের সীমান্ত বাহিনীর মহাপরিচালকরা ভারতে মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হওয়া পাঁচ দিনের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, এমন সময় চলতি বছর সর্বাধিক সীমান্ত হত্যার ঘটনার হিসাব পাওয়া গেল।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কমপক্ষে ৪৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি বা নির্যাতন করে হত্যা করেছে বিএসএফ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ২০১০ সালের পর থেকে সীমান্ত হত্যা কমতে শুরু করেছিল। পরে সেটি আবার বাড়তে শুরু করে। ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলি বা নির্যাতনে সর্বাধিক ৪৩ জনের মৃত্যু হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়ে জানান, বিএসএফ কর্তৃক ২০০৯ সালে সীমান্ত হত্যার সংখ্যা ছিল ৬৬, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ এবং ২০১৮ সালে মাত্র ৩টি।
তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (এএসকে) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ২৬, ২০১৪ সালে ৩৩, ২০১৫ সালে ৪৬, ২০১৬ সালে ৩১, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৪ এবং ২০১৯ সালে ৪৩টি সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
তবে সীমান্ত অঞ্চলে যারা আহত বা অপহরণের শিকার হয়েছিল তাদেরকে এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
২০১১ সালে, বিএসএফ কর্তৃক ১৫ বছর বয়সী বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানিকে হত্যার পর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্থান পায়।
শূন্য মৃত্যুর প্রতিশ্রুতির পরও চলতে থাকে হত্যা
ভারত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সীমান্তের মৃত্যু শূন্যে আনার বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার। তবে বিএসএফের প্রতিশ্রুতির সাথে বাস্তবতা ভিন্ন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তারা সীমান্ত হত্যা হ্রাসে ব্যবস্থা নেবেন।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিএসএফের মহাপরিচালকরা ঢাকায় চার দিনের সম্মেলনে বৈঠক করেন যেখানে তারা সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি, হত্যা ও আহত করা এবং মাদক পাচারের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
তারপরও একের পর এক চলতেই থাকে অমানবিক হত্যাকাণ্ড।
সর্বশেষ, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় জাহিদুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ।
এর আগে ১০ ডিসেম্বর একই ইউনিয়নের সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে আবু তালেব নামে ৩২ বছর বয়সী আরেক বাংলাদেশি মারা যান।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, করোনাভাইরাস সঙ্কটের সময়েও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সীমান্তে সেসব অস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত ছিল।
তিনি বলেন, “সীমান্তে নিহত হওয়া কোনও লোককে কোনও অস্ত্র বা বিস্ফোরকসহ পাওয়া যায়নি, এটা স্পষ্ট যে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী আমাদের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে।”
কেবল দুই দেশের মধ্যে আলোচনাই সংকট সমাধান করতে পারে না, বাংলাদেশকে বিষয়টির আন্তর্জাতিক সমাধানের জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করার মাধ্যমে বিষয়টির যথাযথ সমাধান করতে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গত ১৭ ডিসেম্বর সীমান্ত হত্যাকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটি দাগ বলে বর্ণনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনের পরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোমেন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন যে সীমান্তে কোনও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না এবং আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি (মোদী) এই বিষয়ে নতুন করে বাহিনীকে (বিএসএফ) নির্দেশ দেবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছিলেন যে হত্যাকাণ্ডকে শূন্যে নামাতে উভয় পক্ষ সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাজ করবে।
“দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ হত্যাকেন্দ্র”
বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি গত রবিবার (২০ ডিসেম্বর) অভিযোগ করেছে যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত একটি “দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ হত্যাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে”।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, “যখন সীমান্তে পাইকারি হারে বাংলাদেশি নিহত হচ্ছে, তখন আমাদের সরকার শুধু নীরব থাকছে না, বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের হত্যার বৈধতা দিচ্ছে।”
নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, “ভোট না দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের নতজানু বৈদেশিক নীতির কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন বিশ্বের রক্তাক্ত একটি দেশ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মারাত্মক হত্যাকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
বিএনপি নেতা অভিযোগ করেন, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পতাকা বৈঠক করা এবং নিহতদের মরদেহ গ্রহণ করা ছাড়া বিজিবির কোনও তত্পরতা চোখে পড়ে না।
দলটি সোমবার (২১ ডিসেম্বর) বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে।
দলীয় চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএসএফ ধারাবাহিকভাবে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে।
তিনি হত্যাকাণ্ড বন্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানান
সীমান্ত হত্যা: ডিজি-পর্যায়ের সম্মেলনকে অগ্রাধিকার
দ্বিপাক্ষিক ও সীমান্ত নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ে মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) থেকে শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী মহাপরিচালক (ডিজি) পর্যায়ে আসামের গুয়াহাটিতে একটি সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে।
বৈঠকে যৌথ সীমান্ত সুরক্ষা ব্যবস্থাপনার বিষয়, অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোকে বেড়া দেওয়া এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। বৈঠকে বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে জোর দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম
১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন এবং ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দেবেন বিএসএফের ডিজি রাকেশ আস্থানা।
বিজিবির পরিচালক (অপারেশনস) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, সীমান্ত হত্যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এবং সম্প্রতি বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া সম্মেলনে আমরা বিষয়টিকে আবারও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চাপ প্রয়োগ করব। এছাড়া সীমান্ত লঙ্ঘন, চোরাচালান ও সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়েও সম্মেলনে আলোচনা করা হবে।”
মতামত দিন