‘একটার পর একটা ডেট পড়ছে কিন্তু বিচার পাচ্ছি না। আমি আর কতকাল অপেক্ষা করবো, আরতো পারছি না’
বিয়ের ২০ দিনের মাথায় তালাক দেন স্বামী খয়বর আলী সরদার ওরফে খয়ের আলী। বাবার বাড়িতে ফিরে আসার ২১ দিনের মাথায় প্রাক্তন স্বামী খয়বর আলী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন ভুক্তভোগী নারী। মামলা (মামলা নং-১০৮/২০১০) হলে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণও মেলে। ওই ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন ভুক্তভোগী। বাংলাদেশ পুলিশের ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষায় অভিযুক্তের সাথে জন্ম নেওয়া শিশুর বায়োলজিক্যাল সম্পর্কেরও প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত এই ধর্ষণের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনালে মামলা হলেও দীর্ঘ দশ বছরেও মেলেনি বিচার, জন্ম নেওয়া সন্তানও পায়নি স্বীকৃতি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের কাচিচর এলাকায় বাবার বাড়িতে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তানসহ বসবাস করেন ভুক্তভোগী ওই নারী। বিচার চেয়ে আদালতের বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। দশ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় দিনানিপাত করেন তিনি। মামলার পর থেকেই অভিযুক্ত খয়ের আলী ভুক্তভোগীর বাবাসহ তাকে নানাভাবে হয়রানি করলেও কোনও প্রতিকার পাচ্ছেন না তিনি।
আসামি খয়ের আলী একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় জন্ম নেওয়া সন্তানকে গুম করার ভয় দেখানোসহ তাকে মেরে ফেলার হুমকি চলছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু মিলছে না বিচার।
ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, “আমাকে তালাক দেওয়ার পর আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে খয়ের আলী। সেই ধর্ষণের বিচার চেয়ে আদালতে মামলা করি। পরে বুঝতে পারি ধর্ষণে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়েছি। বিষয়টি পরবর্তীতে আদালতের নজরে আনলে আদালত বিষয়টি আমলে নেন এবং সন্তান জন্ম নেওয়ার পর আদালতের নির্দেশে আমার, আমার সন্তান ও অভিযুক্ত খয়ের আলীর ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে যে আমার সন্তান খয়েরের ধর্ষণের ফল। কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরেও আমি ধর্ষণের বিচার পাচ্ছি না, আমার সন্তানও কোনও স্বীকৃতি পাচ্ছে না। একটার পর একটা ডেট পড়ছে কিন্তু বিচার পাচ্ছি না। আমি আর কতকাল অপেক্ষা করবো, আরতো পারছি না।”
এলাকায় প্রভাবশালী ও অর্থবিত্তের মালিক হওয়ায় খয়বর আলী নানাভাবে হয়রানি করাসহ টাকার বিনিময়ে বিচার বিলম্বিত করছে, এমন অভিযোগ করে ভুক্তভোগী নারী বলেন, “মামলার পর থেকে খয়ের আলী আমাকে ও আমার বাবাকে নানাভাবে হয়রানি করছে। এরমধ্যে সে ফয়সালার কথা বলে আমার বাবাকে ডেকে নিয়ে মাদকের মিথ্যা মামলায় এবং জামাত সম্পৃক্ততার মিথ্যা অভিযোগে দুইবার জেল খাটিয়েছে। আমাদের এক টুকরো জমি নিজের বউয়ের নামে রেকর্ড করে নিছে। আমার মেয়েকে গুম করার হুমকিসহ আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে। আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান। কাপড় সেলাই করে কোনও রকমে মেয়েকে নিয়ে জীবন চালাচ্ছি। খয়বরের (খয়ের) ভয়ে মেয়েকে স্কুলেও পাঠাতে পারি না। সবসময় মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে হয়। অথচ ধর্ষক হয়েও সে (খয়ের) প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, আমাদেরকে ভয় ভীতি দেখায়।”
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে আসামি খয়ের আলীর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারীর করা মামলায় ধর্ষণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে মেডিকেল রিপোর্টে তার সত্যতা মিলেছে। এছাড়াও ভুক্তভোগী নারী, তার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান ও অভিযুক্ত খয়ের আলীর ডিএনও টেস্টের রিপোর্টেও প্রমাণ মিলেছে যে ওই নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তানের বায়োলজিক্যাল বাবা খয়ের আলী। সব প্রমাণ থাকলেও অজানা কারণে এ মামলার রায় বিলম্বিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “ওই মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তি-তর্ক সকল কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এখন শুধু রায়ের অপেক্ষা। রায়তো আমি দিবো না, রায় দিবেন বিচারক।”
স্বাক্ষ্য প্রমাণে ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হয়েছে জানিয়ে পিপি বলেন, “ডিএনএ টেস্টেও প্রমাণ হয়েছে ওই নারীর গর্ভের সন্তান অভিযুক্ত খয়ের আলীর। এ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু ঠিক কী কারণে রায় বিলম্বিত হচ্ছে এটা আমার জানা নেই।”
মতামত দিন