এভাবে অনেকে রোগীই প্লাজমার অভাবে মৃত্যুবরণ করছেন যারা হয়তো প্রতারণার ফাঁদে না পড়লে বেঁচে যেতেন
গত ১৯ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন কাস্টমস ইনস্পেক্টর কবির হোসেন শিকদার (৫৫)। একই কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন তার ছেলে ও মেয়ে।
এর ২৩ দিন পর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাকে তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা কবিরের পরিবারের লোকজন ও তার সহকর্মীদের জানান যে জরুরি ভিত্তিতে এক ব্যাগ এবি পজিটিভ প্লাজমা দরকার। সাথে সাথে পাগলের মতো প্লাজমা খোঁজা শুরু করেন তারা।
এরই মধ্যে এক ব্যক্তি মোবাইলে তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানায় যে, তিনি সম্প্রতি করোনাভাইরাস থেকে আরোগ্য লাভ করেছেন এবং প্লাজমা দান করতে ইচ্ছুক।
কবিরের সহকর্মী কাস্টমস ইনস্পেক্টর মনিরুল ইসলাম ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, পরে ওই ব্যক্তি জানান যে তিনি ঢাকার বাইরে থাকেন এবং তার কাছে ঢাকায় আসার মতো টাকা নেই। যাতায়াত বাবদ ৫ হাজার টাকা বিকাশ করলে তিনি ঢাকায় আসতে পারবেন।
মনিরুল বলেন, “আমরা সাথে সাথেই তাকে টাকা বিকাশ করি এবং পরের দিন ওই ব্যক্তি জানান তিনি ঢাকায় পৌঁছে আসাদগেটের একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছেন। যখন প্লাজমা লাগবে জানালেই তিনি আসতে পারবেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চিকিৎসকরা প্লাজমা দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু সে সময় ওই ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।”
পরে প্লাজমার অভাবে গত ২৮ জুলাই মৃত্যু হয় কবির হোসেন শিকদারের। এ ঘটনায় কবিরের পরিবারের পক্ষে মনিরুল ইসলাম তেজগাঁও থানায় প্রথমে একটি জিডি করেন এবং ২২ আগস্ট মামলা করেন।
এর প্রেক্ষিতে অভিযান চালিয়ে ওই ব্যক্তিকে রাজধানীর সাভার থেকে গ্রেফতার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গ্রেফতার ওই ব্যক্তির নাম আলিফ ইসলাম (৩২)। তিনি কুমিল্লার বাসিন্দা।
ডিবি পুলিশ তেজগাঁও ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল এ প্রসঙ্গে বলেন, “কিছু কিছু মানুষ প্লাজমা দানের নামে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে। এরা কখনও সংঘবদ্ধ হয়, কখনও ব্যক্তিগতভাবে প্রতারণা করছে। আমরা এই ধরনের চক্রের তিন থেকে চার সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “এইসব প্রতারকরা হাসপাতাল কিংবা ফেসবুক থেকে আক্রান্তের পরিবারের সদস্যদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে। তারপর তারা রোগীদের স্বজনদের ফোন দিয়ে প্লাজমা দোনার হিসেবে পরিচয় দেয়। কিন্তু প্লাজমা দানের সাথে আর্থিক লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ মানবিক একটি বিষয়। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হতে হবে।”
এর আগে পুরান ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে ফারজানা ইয়াসমিন (৪৯) নামে এক নারী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত ১৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন। গত ৩১ মে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ জুন চিকিৎসকরা জানান রোগীর জন্য বি-নেগেটিভ প্লাজমা দরকার।
এরপর রোগীর স্বজনরা বিভিন্ন উপায়ে প্লাজমা খুঁজতে থাকেন। তারা দুই লাখ সদস্য বিশিষ্ট ফেসবুক পেজ “প্লাজমা ব্যাংক অব বাংলাদেশ”-এ একটি পোস্ট দেন।
ফারজানা ইয়াসমিনের ছেলে রুসলান আদিব ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে আমাকে একজন ফোন দিয়ে বলেন যে তিনি প্লাজমা দিতে পারবেন। কিন্তু ঢাকায় আসা-যাওয়ার জন্য তাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে।”
রুসলান ৫ হাজার টাকা বিকাশ করলেও ওই প্রতারক আসেনি। অসহায় পরিস্থিতিতে পড়া পরিবারটি পরে ঢাকা দক্ষিণখানের আরেকজনকে ১ হাজার টাকা পাঠালেও কেউ প্লাজমা দিতে আসেনি। এক পর্যায়ে প্লাজমার অভাবে রুসলানের মায়ের মৃত্যু হয়।
এই দুই প্রতারককেও আটক করতে সক্ষম হয়েছে ডিবি পুলিশ। আটক দুই ব্যক্তি হলো – শরীফ খান (৩২) ও হৃদয় আহমেদ (২৩)।
পুলিশ বলছে, করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর স্টাফরা এই চক্রের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।
গত ৮ আগস্ট শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালের কর্মী আহসানুল ফরিদকে (৪৭) এই চক্রের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তিনি প্লাজমা সংগ্রহ করে বিক্রি করছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, ফরিদ করোনাভাইরাস থেকে আরোগ্য লাভ করা রোগীদের খুঁজে বের করতো। পরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাদের কাছ থেকে প্লাজমা চাইতেন।
ওসি আবুল হাসান বলেন, “প্লাজমা সংগ্রহের পর বিভিন্ন দামে বিক্রি করছিল ফরিদ। এমনকি প্রতি ব্যাগ প্লাজমার জন্য সে ১৫ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত টাকা নিয়েছে এই পেশাদার প্রতারক।”
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, এরকম প্রায় ১০টি প্রতারক চক্র বিভিন্ন হাসপাতাল ও “প্লাজমা ব্যাংক অব বাংলাদেশ” নামের ফেসবুক পেজের ওপর নজরদারি করছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সাথে প্রতারণার জন্য। পরে তারা প্লাজমা দাতা হিসেবে ফোন দিয়ে আক্রান্ত রোগীদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে তাদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। এতে প্রাণ যাচ্ছে অনেক করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর, যারা প্রতারণার ফাঁদে না পড়লে বেঁচে যেতেন। এই ধরনের প্রতারকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য সক্লের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি।
মতামত দিন