টানা তিন ঘণ্টার চেষ্টায় প্রাণীটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন তারা
খুলনার রূপসা এলাকার বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে একটি গন্ধগোকুল উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার (২৮ মে) বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে প্রাণীটিকে উদ্ধার করে খুলনা সদরের টুটপাড়া ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গন্ধগোকুলটিকে ওয়াটার রিজার্ভারের ভেতর ঘোরাফেরা করতে দেখেন বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কন্ট্রোল রুম অপারেটর শাহীন আলম। তিনি বিষয়টি প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান মিলন ও কেমিক্যাল অপারেটর আবু সালেহ মুহাম্মদ সুলতানকে জানান। তিনজনে মিলে প্ল্যান্টের ভেতর বালতি ফেলে প্রাণীটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর জাতীয় জরুরি সহায়তা নম্বর ৯৯৯ ও ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চান তারা।
জরুরি সহায়তা নম্বর থেকে খুলনা বন বিভাগের দপ্তরে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযান সাময়িক স্থগিত রয়েছে বলে জানান বনকর্মকর্তারা। তবে তারা স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
আরও পড়ুন - ভাইরাল হওয়া প্রাণীটি চিতাবাঘ নয়, চিতা বিড়ালের বাচ্চা
এ বিষয়ে আবু সালেহ মুহাম্মদ সুলতান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “প্রায় ৭২ ফিট গভীর খাড়া এই ওয়াটার রিজার্ভারে নামার মতো সক্ষমতা আমাদের ছিল না। তাই প্রাণীটিকে বাঁচাতে বিকল্প খুঁজতে থাকি।”
খবর পেয়ে খুলনা সদরের টুটপাড়া ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বেলা ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু প্ল্যান্টের চীনা কর্মীরা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সেখানে ঢুকতে বাধা দেন। কিন্তু মনিরুজ্জামান, আবু সালেহ ও শাহীন বিপন্ন প্রাণীটিকে উদ্ধারের গুরুত্ব বোঝালে বিদেশিরা মত পরিবর্তন করেন। পরে টানা তিন ঘণ্টার বিভিন্ন কৌশলে চেষ্টা করে প্রাণীটিকে উদ্ধারে সক্ষম হন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা।
আবু সালেহ আরও বলেন, “এই প্রাণীগুলো প্রকৃতি থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা যেটিকে উদ্ধার করেছি, হতে পারে অত্র অঞ্চলে এটিই সর্বশেষ। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা একটি প্রাণীকে বাঁচাতে পেরেছি, এতে আমরা আনন্দিত।”
গন্ধগোকুল উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। আবু সালেহ মুহাম্মদ সুলতান
একটি বন্যপ্রাণীকে বাঁচাতে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা কেন জীবনের ঝুঁকি নিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে টুটপাড়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নজরুল ইসলাম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ফায়ার সার্ভিস প্রতিটি জীবনকে সমান গুরুত্ব দেয়। এখানে মানুষ নাকি বন্যপ্রাণী সেটি বিবেচ্য নয়। বরং একটি সফল উদ্ধার করতে পেরে আমরা আনন্দিত। আমরা ফায়ার সার্ভিস, লাইফ সেভিং ফোর্স সব সময়, যে কোনো বিপদে সবার পাশে আছি।”
এদিকে, পরিচয় নিশ্চিত হতে ঢাকা ট্রিবিউনের হাতে আসা প্রাণীটির ছবি পাঠানো হয় বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলার কাছে। ছবি দেখে প্রাণীটিকে তিনি গন্ধগোকুল (Large Indian Civet) বলে শনাক্ত করেন।
আরও পড়ুন - বনরুই পাচার ও বিলুপ্তি ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপ কি যথাযথ?
তিনি জানান, নিশাচর এই প্রাণীটি লোকালয়ের কাছাকাছি ঝোপ-জঙ্গলে বাস করে। এরা তাল-খেজুর রস, ফল, সবজি ছাড়াও কৃষির জন্য ক্ষতিকর পোকামাড়র ও ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে। মজার বিষয় হলো, বট বা অন্যান্য গাছের ফল খাওয়ায় এদের মলের সঙ্গে নির্গত বীজগুলোর শতভাগ অঙ্কুরোগদমে হয়, যা উদ্ভিদকূল রক্ষায় দারুণ কার্যকরী।
জোহরা মিলা বলেন, আপনি বনজঙ্গল বা ঝোপ-ঝাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যদি পোলাওয়ের চালের মতো গন্ধ পান তবে বুঝে নেবেন আপনার আশেপাশেই গন্ধগোকুল আছে।
তিনি বলেন, “বনজঙ্গল ধ্বংস, খাদ্যের অভাব, পিটিয়ে হত্যা ইত্যাদি কারণে প্রকৃতির উপকারী এই প্রাণীটি অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন লোকজ ওষুধ ও টোটকা তৈরিতে গন্ধগোকুল হত্যা করা হয়। কিন্তু এসব ওষুধের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং কিছু অসাধু ব্যক্তি দেশের সরল মানুষকে ঠকাচ্ছে। এক সময় দেশে প্রচুর গন্ধগোকুলের দেখা মিললেও বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) বিবেচনায় এটি পৃথিবীর বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রাণীটি সংরক্ষিত। তাই এটি হত্যা বা কোনো ক্ষতি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।”
আরও পড়ুন - পদ্মা সেতুর চীনা শ্রমিকদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সজারু
মতামত দিন