‘সবাই একবার ভেবে দেখুন, মহাসড়ক বাদ দিয়ে জলের মধ্যেই কেন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে? আর কোনো ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি সেজদাবিহীন অশুদ্ধ এই নামাজ পড়বে না, অতিদ্রুত এই ষড়যন্ত্রের পেছনে থাকা বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের কুশীলবদের খুঁজে বের করতে হবে’
খুলনার কয়রা উপজেলা সদরের ২নং কয়রা ক্লোজারের বাঁধ মেরামতের সময় পানির মধ্যে ঈদ জামাত আয়োজন দেশে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
হাঁটু পানিতে ঈদের নামাজ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বিষয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রায়হান কবির চঞ্চল ঢাকা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
“কয়রা উপজেলায় অনুষ্ঠিত ঈদের জামাত নিয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে সেটা সবার সামনে তুলে ধরা উচিৎ বলে আমি মনে করি। কেননা এটা নিয়ে অনেকেই না জেনে অনেক ধরনের মন্তব্য করছেন। বিগত ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্পানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা কয়রা। সাইক্লোনে মানুষের ঘর, গাছসহ অনেক কিছু ভেঙ্গে যায় এবং সব থেকে বড় বিষয় উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে নদীর বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়। ২২ মে থেকে বাঁধ বাধার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ভাঙনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় জোয়ার আসলে সেটি আবারও ভেঙে যাচ্ছে। এজন্য ঈদের দিন সবাইকে বাঁধে কাজ করার জন্য আসতে বলা হয় এবং সেখানেই ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। ঈদের দিন প্রায় ৫ হাজার লোক সেখানে উপস্থিত হয় এবং নামাজ আদায়ের পরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকালে সেমাই ও কাজের পরে খিচুড়ি মাংস দেয়া হয়। কিন্তু কিছু বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। প্রথমত, নামাজ যিনি পড়িয়েছেন তিনি জামায়াতের একজন নেতা ও সাবেক দুইবারের উপজেলা চেয়ারম্যান। শুধুমাত্র এটাই নয়, তার ভাই কয়রা উপজেলা বিএনপির সভাপতি। কিন্তু ইমামের পিছেনে তাকালেই দেখতে পাবেন চশমা পরা একজন ব্যক্তি এবং যিনি তাকবীর দিয়েছেন তিনি কয়রা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি, সাবেক দুইবারের কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বর্তমান কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এছাড়া প্রথম সারিতে যারা দাঁড়িয়ে তাদের অধিকাংশ উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা। কয়রা-পাইকগাছা সংসদীয় আসনের পরিসংখ্যান দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন এখানে জামায়াতের আধিপত্য ছিলো, এ জন্য চেষ্টা করেছে সকলে মিলে কাজ করার। সম্পূর্ণ কাজটা উপজেলা প্রশাসন ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হয়েছে। ইমামতি যিনি করেছেন তিনি জামায়াতের নেতা, কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ ও সকলের নিকট পরিচিত হওয়ায় তাকে ইমাম করা হয়। যেহেতু এইখানে সবদলের লোক ছিলো-এ জন্য অন্য পক্ষকে খুশি করে সবাই মিলে কাজটা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে মাত্র।”
“দ্বিতীয়ত, নামাজ কেনো পানিতে পড়া হলো- ওইখানে যে জায়গা ছিলো তার বেশিরভাগ জায়গায় পানি ছিলো, আর পিছনে যে উঁচু জায়গা সেটা বেড়িবাঁধ। ঐখানে পাশাপাশি ২-৩ জনের বেশি দাঁড়ানো যায় না, আর ওই বাঁধ এতটাই দুর্বল যে বেশি মানুষ দাড়ালে যে বাঁধটুকু বাকি আছে সেটুকুও ভেঙ্গে যাবে। বেশিরভাগ মানুষ যে রাস্তাটা শুকনা ছিলো সেখানে নামাজ পড়ছে। কিন্তু একটা ছবি ভাইরাল হওয়ায় অন্য ছবিগুলো আপনারা দেখেননি এবং প্রায় ৫ হাজার লোক হওয়ায় রাস্তায় সংকুলান হওয়া সম্ভব ছিলো না। তৃতীয়ত, তারা কেন মসজিদে বা অন্য জায়গায় নামাজ পড়েনি এবং সামাজিক দূরত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেছে অনেকেই। প্লাবিত এলাকার একটা মসজিদে নামাজ পড়ার মতো অবস্থা নেই। অন্য জায়গা বা মাঠের কথা যারা বলেছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, নামাজ পড়ার জন্য যে জায়গা আছে সেখেনে নামাজ পড়ে বাঁধে যেতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা লাগবে। আর ততক্ষণে জোয়ার শুরু হবে এবং পানি বৃদ্ধি পাবে। তখন বাঁধ দেওয়া অসম্ভব। এমনকি জোয়ারে বিগত কয়েকদিনে দেয়া বাঁধও কিছুটা ভেঙ্গে গেছে। সুতরাং অন্য কোথাও নামাজ পড়ে বাঁধের কাজ শুরু করা সম্ভব ছিলো না। সামাজিক দূরত্ব নিয়ে যারা বলছেন, ভাই থাকার জায়গা আর পেটে ভাত না থাকলে করোনার কথা আপনারও মনে থাকবে না। ফসলের ক্ষেত ভেসে গেছে এবং সব থেকে বড় অর্থনৈতিক সাপোর্ট মাছের ঘেরে পানি ঢুকে সাদা মাছ (কার্প জাতীয় মাছ) মরে দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে পানি। এই অবস্থায় আপনি যখন সামান্য খাবার পানির জন্য পথ চেয়ে থাকবেন, কখন সেনাবাহিনী পানি নিয়ে আসবে বা ৫ কিলোমিটার নৌকা চালিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হবে, তখন করোনার কথা মনে থাকবে না। আর কয়রায় এখনও কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি এবং এখন চারিদিকে পানি থাকায় বাইরের মানুষ খুবই কম আসতে পারছে। এরপরও কারো কোনো বিষয়ে জানার থাকলে কমেন্টে বলতে পারেন অথবা উপকূলীয় অঞ্চলে কোনো বন্ধু বা আত্মীয় থাকলে তাদের থেকে জানতে পারেন। শুধু এটুকুই বলবো ২৫ মে ২০০৯ এ আইলায় যে ক্ষতি হয়েছিলো, কয়রা সেটা যখন কাটিয়ে উঠেছে, তখন ২০ মে ২০২০ আম্পানে সেই স্বপ্ন লোনাজলে ভাসিয়ে দিয়েছে।”
তিনি আরও লেখেন, “আপনারা কি জানেন আম্পান ঝরে কয়রায় কয়টি গ্রাম প্লাবিত? কত হাজার পরিবার পানিবন্দি? কত লক্ষ মানুষ না খেয়ে আছে? আপনি কি জানেন কত শত মসজিদ, মন্দির, ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে? আপনারা কি জানেন নদীর জোয়ার ভাটার খেলা? আপনি কি জানেন নতুন কাঁচা মাটির রাস্তার উপরে হাঁটাচলা করা যায় না, এটার জন্য মাটি ধসে পড়ে? আপনারা তো কয়রা সম্পর্কেই জানেন না। তাহলে কয়রা নিয়ে লিখতে বসছেন কোন আন্দাজে?”
রায়হান কবির চঞ্চল পানিতে ঈদ জামাতের পক্ষ নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “কয়রায় কিছু এলাকায় বাঁধ উঁচু ছিল, কিন্তু তার ওপর দাঁড়ালে অত মানুষের ভার সামলানোর মত শক্ত ছিল না সেই বাঁধ। এলাকার কোনো কোনো মসজিদে ঈদ জামাত পড়ার মত অবস্থা ছিল। তবে দূরে থাকা মসজিদে ঈদ জামাত পড়ে বাঁধ আটকানোর জন্য ফিরে আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগতো। ততক্ষণে জোয়ার এসে সব তলিয়ে দিত। তাই বাঁধ রক্ষার সুবিধার্থে হাঁটু পানিতে নামাজ আদায় করা হয়।”
তবে হাঁটু পানিতে ঈদের নামাজ পড়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আল মাসুম খান। এ বিষয়ে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন-
“খুলনার কয়রায় জলের মধ্যে ঈদের জামাত, পুরো ঘটনাটি সাজানো। সেই বাসন্তীর জালের মতো ঘটনা, বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে এই ছবি। শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা। পাশেই উঁচু সড়ক থাকতে জলের মধ্যেই কেন ঈদের নামাজ পড়তে হবে? পেশাদার ফটো সাংবাদিকদের তোলা, আর পানির মধ্যে জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করা, ফেইক সেজদা এবং ব্যাপক প্রচারণা; বিএনপি-জামায়াত-শিবির প্রথম প্রচার করে। আর ঢাকার সস্তা গণমাধ্যমগুলোও গোগ্রাসে গিলছে; এই ষড়যন্ত্রের রহস্য উদঘাটন জরুরি। এই ঈদের জামাতে ইমামতি করেছে কয়রা জামায়াতের আমির, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা আ খ ম তমিজ উদদীন। সবাই একবার ভেবে দেখুন, মহাসড়ক বাদ দিয়ে জলের মধ্যেই কেন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে? আর কোনো ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি সেজদাবিহীন অশুদ্ধ এই নামাজ পড়বে না, অতিদ্রুত এই ষড়যন্ত্রের পেছনে থাকা বিএনপি জামায়াত ও শিবিরের কুশীলবদের খুঁজে বের করতে হবে।”
পানিতে নামাজ পড়াকে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে খুলনা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক শফিকুর রহমান পলাশ ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “এটা জামায়াতি ষড়যন্ত্র। পুরাটাই ক্যামোফ্লেক্স করা হয়েছে। দেশ-বিদেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। যেমনটি এর আগে জামায়াত নেতা কারাবন্দী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে তারা গল্প বানিয়েছিল।”
তিনি বলেন, “ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতিরা আবারও মিথ্যাচারে মাঠে নেমেছে। পানিতে নামাজ পড়ার এই ছবি আমাদের ছেলে মেয়েরাও লাইক দিয়েছে, শেয়ার করেছে না জেনেই। চলমান করোনাভাইরাস ও আম্ফানে দেশ ও জাতি যখন দিশেহারা তখন জামায়াতিরা রাজিনীতি করতে মাঠে নেমেছে। সহজ-সরল, ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ব্যবহার করেছেন জামায়াত নেতারা। এটা পরিকল্পিতভাবেই তারা করেছে।”
তিনি বলেন, “কৌতুহলি হয়ে আমি নিজেও ঘটনার পরে খোঁজ-খবর নিয়েছি। কয়রা উপজেলা সদর ইউনিয়নে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ হাঁটু পানিতে পড়া নিয়ে চারিদিকে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ওই এলাকায় কি কোনো শুকনো জায়গা নেই, যেখানে নামাজ আদায় করা সম্ভব? বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে আমরা জানতে পারি, জামায়াতের একজন আমির ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তিনি ও তার দলীয় নেতা-কর্মীরা এলাকার সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে এই কাজ করেছেন। আসল বাস্তবতা হচ্ছে প্রকৃতির উপর কোনো মানুষের হাত নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ এলাকার মানুষের জন্য অনেক কাজ করছেন এবং করে যাচ্ছেন। কাজ করেছেন বলেই এত বড় দুর্যোগেও সেখানে মানুষের কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।”
কয়রাবাসীর উদ্দেশ্যে পলাশ বলেন, “হতাশ হবেন না। ইতোমধ্যে আমাদের প্রিয় নেত্রী সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাঁধ নির্মাণের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন।”
কয়রা অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ছাত্রলীগসহ সবাইকে সতর্কতার সাথে কাজ করার অনুরোধ করে তিনি আরও বলেন, “গুজব ছড়ানোসহ অপপ্রচার সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে ভুল প্রচার করা উচিৎ নয়,আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, আসুন আমরা গুজব পরিহার করি।”
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “কয়রা পানিতে ভেসে গেছে। এমন কোনো স্থান নেই, এমন কোনো মসজিদ নেই, এমন কোনো ঈদগা নেই সেখানে নামাজ পড়ার পরিবেশ আছে। তাই ঘর-বাড়ি রক্ষায় মানুষকে বাঁধ নির্মাণ কাজে শামিল হওয়ার আহবান জানিয়েছিলাম। তারা গত ৫ দিন ধরে বাঁধ নির্মাণ কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন।”
শফিকুল ইসলাম বলেন, “বাঁধের ওপর ঈদ জামাত আয়োজন নিয়ে একটি মহল রাজনীতি করতে চায়। কয়রার মানুষের ভাগ্য নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি করার সুযোগ বা প্রয়োজন নেই।”
পানিতে ঈদের নামাজের ইমামতি করেছেন কয়রা জামায়াতের আমির ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মওলানা আ খ ম তমিজ উদদীন। এ বিষয়ে কথা বলতে মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা বলেন, “ঈদ জামাতের বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাই তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই।”
মতামত দিন